তার চেয়ে চমকপ্রদ ঘটনা একটা শুনলাম। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল দেশে ফিরে ক্যাম্পাসের একটি অংশে জায়গা করে নেয় বিজয়লাভের দিন দুই পরে। তখন তাঁদের সমাদরের লেশমাত্র অভাব হয়নি। কয়েকদিন পরে দলটি যখন ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যায় তখন ট্রাকে করে নিয়ে যায় কয়েকটি শ্রেণিকক্ষের আসবাবপত্র, টাইপরাইটার এবং ফিল্ড টেলিফোন-মার্কা আমাদের কয়েকটি টেলিফোন সেট। বিবরণ শুনে আমি যৎপরোনাস্তি লজ্জিত হই। যিনি এই দলের অধিকর্তা ছিলেন, পরে তিনি বেশ পদোন্নতি লাভ করেছিলেন এবং সময়ের আগে সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়ে রাজনীতিতে যোগ দিয়ে মন্ত্রীর পদ অলংকৃত করেছিলেন।
একটি ট্রাজিক ঘটনার কথাও এ-সময়ে জানতে পারি। আমার অনুপস্থিতিতে এ এফ রহমান হলের প্রোভোস্ট নিযুক্ত হয়েছিলেন ইতিহাস বিভাগের রিডার ড. জাকিউদ্দীন আহমদ। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যে ক্যাম্পাসে বাড়ির সামনে পায়চারি করার সময়ে তিনি আকস্মিকভাবে হৃদরোগে আক্রান্ত হন এবং ১৩ দিন পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর স্ত্রী ও শিশুপুত্র তখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসে আছেন। ভদ্রমহিলার সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি বারবার স্বামীর হয়ে আমার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করতে লাগলেন–আমার অবর্তমানে প্রোভোস্টের পদটি তিনি গ্রহণ করেছিলেন বলে। আমি বারবার তাঁকে বোঝাতে চেষ্টা করি যে, এটি একটি প্রশাসনিক ব্যাপার, কাউকে না কাউকে ওই দায়িত্ব পালন করতে হতো, এবং তা নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে আমার ক্ষুব্ধ হওয়ার কারণ নেই। কিন্তু আমার মুখ থেকে ‘ক্ষমা করেছি’ না শোনা পর্যন্ত ভদ্রমহিলা ক্ষান্ত হলেন না। আমি আর কখনো এমন বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হইনি।
আমরা চট্টগ্রামে পৌঁছোবার পরদিন বিকেলে মুসলিম ইনসটিটিউট হলে আমাদের–‘বাংলার সংগ্রামী বুদ্ধিজীবীদের’–বীরোচিত সংবর্ধনা। আয়োজন করেছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু)–যার সাধারণ সম্পাদক আবদুর রব মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই শহীদ হয়েছিল। বক্তৃতায় যেসব অতিশয়োক্তি করা হয়েছিল, তা অপ্রত্যাশিত ছিল না কিন্তু জনসমাগমের ব্যাপকতা এবং আবেগ ও আন্তরিকতার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশের মাত্রা আমাদের প্রত্যাশার অতীত ছিল।
মুসলিম ইনসটিটিউটে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন শহীদ নূতনচন্দ্র সিংহের কনিষ্ঠ পুত্র প্রফুল্ল সিংহ। এই ক মাসে তার পৃথিবী সম্পূর্ণ বদলে গেছে। সেই ধাক্কা সামলাচ্ছেন তিনি–এখন সবই আবার তাকে নতুন করে শুরু করতে হবে। সভার শেষে লোকজনের সঙ্গে কথা বলার এক পর্যায়ে লক্ষ করলাম, আমার মামাতো ভাই সৈয়দ কামরুজ্জামান এবং বন্ধু আবদুল আলী ও মীর মোজাম্মেল হোসেন দাঁড়িয়ে আছেন। দ্রুত তাদের কাছে গেলাম এবং কামরু ভাইয়ের গাড়িতে করে বাটালি হিলে রেলওয়ে কোয়ার্টার্সে এসে পৌঁছোলাম। একই বাড়ির একতলায় আলীর এবং তাঁর জ্যেষ্ঠ এ জেড এম আবদুল আলিমের পরিবারের সঙ্গে দেখা করে দোতলায় মোজাম্মেলের বাড়িতে উঠলাম। সেখানে তাঁর মা থাকতেন। তাঁর সঙ্গে দেখা হওয়ার আগেই ভেতর থেকে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন মিসেস আতাউর রহমান।
আমার দীর্ঘদিনের পরিচিত এবং মোজাম্মেলের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু আতাউর রহমান ছিলেন রেলওয়ের জনসংযোগ বিভাগের কর্মকর্তা। অসহযোগ আন্দোলনের সময়ে তার ভূমিকা ছিল সক্রিয় এবং জনসংযোগ বিভাগের লোক হওয়ায় সবার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগও ছিল কিছু বেশি। চট্টগ্রাম শহর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দখলে চলে গেলে রেলের অবাঙালি কর্মীরা তাঁর প্রতি প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠেন। আতাউর তখন আত্মগোপন করেন এবং অফিসে যোগদান করার সরকারি নির্দেশ জারি হওয়ার পরেও কর্মক্ষেত্রে ফিরে আসেননি। এক পীরসাহেব আতাউরের স্ত্রীকে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, অফিসে যোগ দিলে আতাউরের কোনো ক্ষতি হবে না। অফিসে যাওয়ার পরপরই পাকিস্তানি সেনারা তাকে ধরে নিয়ে যায়–তিনি আর ফিরে আসেননি। শুনেছি, টাকাপয়সা-গয়নাগাটি নিয়ে আরো কাউকে কাউকে পীরসাহেব এরকম পরামর্শ দিয়েছিলেন এবং তাঁদের সবার একই পরিণতি ঘটেছিল। এখন এক ছেলে, এক মেয়ে এবং একরাশ মনস্তাপ নিয়ে আতাউরের স্ত্রী দিশেহারা। তাঁকে আমি কিছুই বলে উঠতে পারছিলাম না।
চট্টগ্রামে গিয়ে মনে হলো, পূর্বপদে ফিরে আসার তেমন আগ্রহ যেন ড. মল্লিকের নেই। তার কয়েক দিন পরে তিনি শিক্ষাসচিব হিসেবে যোগ দেওয়ায় তাই অবাক হইনি, যদিও মনে হয়েছিল যে, ওটি তাঁর পক্ষে উপযুক্ত পদ নয়। তবে স্বয়ং বঙ্গবন্ধু তাঁকে এই নিয়োগ গ্রহণ করতে অনুরোধ করেছিলেন। সদ্যস্বাধীন দেশে শিক্ষাব্যবস্থার পুনর্বিন্যাসে তার চিন্তা ও অভিজ্ঞতা দেশের কাজে লাগবে বলে এবং সেই আহ্বান ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভবপর ছিল না তাঁর পক্ষে। নতুন ভূমিকায় তাঁকে দেখলাম ২২ জানুয়ারিতে শিক্ষামন্ত্রী ইউসুফ আলীর দপ্তরে আহূত এক সভায়। শিক্ষামন্ত্রী হওয়ার আগেই বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে ইউসুফ আলী যে-নৈরাজ্যের সৃষ্টি করেছিলেন, সে-কথাটা এখানে বলে নিই। পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষ থেকে শিক্ষাবিষয়ে আমি যে কয়েকটি কাগজ তৈরি করেছিলাম, তার একটিতে প্রস্তাব করা হয়েছিল যে, ১৯৭১ সালের ১ মার্চ যে যে-ক্লাসে পড়ত, ১৯৭২ সালের ১ মার্চে তাকে আবার সেখান থেকে পড়াশোনা শুরু করতে হবে; এই একটি বছর জাতীয় ক্ষতি হিসেবে পরিগণিত হবে; এবং সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়ঃসীমা এক বছর বাড়িয়ে। দেওয়া হবে। কিন্তু মন্ত্রিসভায় এ-প্রস্তাব বিবেচিত হওয়ার আগেই জাতীয় পরিষদ-সদস্য ইউসুফ আলী এক জনসভায় ঘোষণা করেন যে, স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গণউন্নতি দেওয়া হলো, অর্থাৎ ১৯৭১ সালে যে যেখানে পড়ত, ১৯৭২ সালে তার পরবর্তী শ্রেণিতে সে উন্নীত হবে। এই ঘোষণার বিষয়ে তিনি যে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে পরামর্শ করেননি, সে-কথা আমি তাজউদ্দীনের কাছ থেকে জেনেছিলাম। বলা বাহুল্য, ঘোষণাটি ছাত্রদের কাছে খুব জনপ্রিয়। হয়েছিল এবং তা প্রত্যাহার করার মতো সাহস সরকারের হয়নি। এতে যে দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে কী সর্বনাশ হলো, অনেকে তা ভেবে দেখেননি। এই কারণে ইউসুফ আলীর প্রতি মনটা বিমুখ হয়ে থাকলেও তাঁর আহ্বানে তাঁর দপ্তরে গিয়েছিলাম বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ শিক্ষাব্যবস্থার রূপরেখা সম্পর্কে আলোচনা করতে। শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষাসচিব ছাড়া তাতে উপস্থিত ছিলেন মুহাম্মদ কুদরাত-এ-খুদা, মুহম্মদ এনামুল হক, আবুল ফজল, কবীর চৌধুরী, সৈয়দ আলী আহসান ও মযহারুল ইসলাম, আর ছিলাম আমি। সেখানে সুপারিশ করা হয় যে, দেশে একই পদ্ধতির শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তিত হবে এবং একই মাধ্যমে শিক্ষাদান করা হবে, আর এসব বিষয়ে বিস্তারিত সুপারিশ প্রণয়নের জন্য সরকার একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করবেন। বাংলা ভাষায় উচ্চ শিক্ষাদানের ব্যবস্থা যে তখনই চালু করা সম্ভব, এ-সম্পর্কে সবচেয়ে দ্বিধাহীন ছিলেন কুদরাত-এ-খুদা। তবে অভিন্ন শিক্ষাপদ্ধতি-প্রবর্তনের প্রশ্নে আবুল ফজল একমত হলেন না, তিনি চাইলেন, সংস্কার করে হলেও মাদ্রাসা শিক্ষার স্বতন্ত্র ধারাটি অব্যাহত রাখতে। তিনি মনে করছিলেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় বোধহয় সাধারণ শিক্ষা ও মাদ্রাসা শিক্ষাকে একীভূত করার প্রস্তাব উঠেছে। আমরা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, শিক্ষাগত বিবেচনায়ই এটি কাম্য, তিনি তা মানলেন না। কয়েক দিন পরে দৈনিক বাংলায় মুহাম্মদ জাহাঙ্গীরকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি নিজের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মাদ্রাসা শিক্ষার স্বাতন্ত্র্যরক্ষার পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করেন।