পাকিস্তানে আটক বাঙালিদের ফিরিয়ে আনার জন্যেও সরকারের ওপর চাপের সৃষ্টি হচ্ছে। সিভিল সার্ভিসের সাবেক সদস্য, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি, আহমদ ফজলুর রহমানের সভাপতিত্বে একটি কমিটি গঠিত হয়েছে এ-বিষয়ে নানা উদযোগ নিতে। কিন্তু বোঝা যাচ্ছে, কাজটা সহজ হবে না। বাঙালিদের আটকে রেখে পাকিস্তান দর-কষাকষি করবে যুদ্ধবন্দিদের ছাড়িয়ে নিতে।
শোনা যাচ্ছে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগীদের অনেকে আশ্রয় নিয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামে–সেখান থেকে মুসলিম বাংলা প্রতিষ্ঠার সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনা করবে বলে। তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ও ভারতীয় সেনাবাহিনী। মিলিতভাবে অভিযানও চালিয়েছে সে-অঞ্চলে।
১১ জানুয়ারি সন্ধ্যায় তাজউদ্দীনের সঙ্গে এত বিষয়ে আমার কথা হয়নি। তিনি বঙ্গভবনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আমার সঙ্গে কথা সেরে যেই তিনি বেরিয়ে এলেন, অমনি বহু লোক তাঁকে ঘিরে ধরল–সবারই কিছু না কিছু আরজি আছে। প্রথমে বিনীতভাবে, শেষে রাগতস্বরে তিনি বললেন, রাষ্ট্রপতি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন–সময়মতো তাঁর কাছে না গিয়ে আমি আপনাদের। কথা শুনব, এই কি আপনারা আশা করেন?’ যিনি বলছিলেন এবং যাদের বলছিলেন, উভয় পক্ষের প্রতিই আমি সহানুভূতি বোধ করছিলাম।
৩.
পরদিন বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রীরূপে শপথ নিলেন, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী হলেন রাষ্ট্রপতি।
এবারে বঙ্গবন্ধু সকল মুক্তিযোদ্ধাকে আহ্বান জানালেন অস্ত্র সমর্পণ করতে। কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন বাহিনী, মুজিব বাহিনী, ছাত্র ইউনিয়নের মুক্তিযোদ্ধারা, মায়া গ্রুপ–একে একে অস্ত্র সমর্পণ করলো নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে শুনেছিলাম, মুক্তিবাহিনীর মধ্যে শেখ ফজলুল হক মনি ও সিরাজুল আলম খানের অনুসারীদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে–শেষোক্তরা সমাজতন্ত্রের যত অনুরাগী, প্রথমোক্তরা তত নয়। তবে অস্ত্র সমর্পণ করলেন তারা একজোট হয়ে। সেদিনই নতুন স্লোগান শোনা গেল : মুজিববাদ জিন্দাবাদ। মুজিববাদ বলতে যে কী বোঝায়, তা আমার জানা ছিল না; দেখা গেল, অনেকেরই জানা নেই। কিন্তু পরবর্তীকালে কথাটা খুব চালু হয়ে যায়, এমনকি, মুজিব বাহিনীর তরুণ নেতারা মুজিববাদ প্রতিষ্ঠার জন্যে দ্বিতীয়বার সংগ্রামের আহ্বানও জানিয়েছিলেন। সরকারি পর্যায়ে কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ঘোষিত তিন নীতিকে দেশের লক্ষ্য বলে প্রচার করা হচ্ছে। সেই অনুযায়ী, বড় একটা রাষ্ট্রায়ত্ত খাত গঠিত হতে চলেছে, এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তবে তা পরিচালনার মতো দক্ষ ও নির্লোভ জনশক্তি আমাদের আছে কি না সে-সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করছেন অনেকে। আমি আশা করছি, দেশপ্রেম দিয়ে সব সংকট পার হওয়া যাবে।
১৩ তারিখে দুপুরে বাড়ি ফিরে শুনি, বাংলা একাডেমি থেকে কয়েকবার আমার খোঁজ করা হয়েছিল। কারণ জানতে পরিচালক কবীর চৌধুরীকে ফোন করলাম। তিনি বললেন, বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হবে আমার সোনার বাংলা’–এটা স্থির হয়ে গেছে, তবে গানটির কয় চরণ জাতীয় সংগীতরূপে গৃহীত হবে, সেই পরামর্শ চাওয়া হয়েছিল বাংলা একাডেমির কাছে। পরামর্শের জন্যে তিনি ডেকেছিলেন কয়েকজনকে, আমাকেও যুক্ত করতে চেয়েছিলেন তার সঙ্গে। তাঁরা সুপারিশ করেছেন, গানটির প্রথম দশ চরণ জাতীয় সংগীত হিসেবে গৃহীত হোক। আমি বললাম, যথার্থ হয়েছে। কিন্তু মনে আফসোস রয়ে গেল, এত বড়ো একটা সিদ্ধান্তের অংশভাগী হওয়া থেকে বঞ্চিত হলাম। ওইদিনই নতুন মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় সংগীত বিষয়ে প্রস্তাব গৃহীত হয়, সেই সঙ্গে রণসংগীত নির্ণীত হয় ‘চল্ চল্ চল্। তার আগে, জানুয়ারির ৪ তারিখে, বাংলাদেশের মানচিত্র-অঙ্কিত পতাকার বদলে সবুজ জমিনের ওপরে লাল সূর্য আঁকা নতুন জাতীয় পতাকার নকশা গৃহীত হয়। মন্ত্রিসভায়। যতদূর জানি, নকশাটা করেছিলেন কামরুল হাসান।
একবার চট্টগ্রামে যেতে হয়। ১৭ বা ১৮ তারিখের সকালে, এক গাড়িতে উপাচার্য ড. এ আর মল্লিক আর পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ শামসুল হক এবং আমার গাড়িতে রেজিস্ট্রার মুহম্মদ খলিলুর রহমান আর আমি রওনা হলাম। অসংখ্য রাস্তাঘাট, পুল ও কালভার্ট ভাঙা–বিকল্প পথ ধরে এগোতে লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে। প্রথমে এক জায়গায় থামতেই দেখি সামনের গাড়িতে খান শামসুর রহমান ওরফে জনসন এবং আবদুল বারেক চৌধুরী ওরফে এবিসি। অপেক্ষমাণ অবস্থায় গাড়ি থেকে নেমে রাস্তায় দাঁড়িয়ে গল্প করা ছাড়া করণীয় কিছু ছিল না। সারাপথ শামসুর রহমান আশপাশের পরিবর্তমান ভূচিত্রের কথা বলে গেলেন। তাঁর মুখে সেদিন বাংলাদেশের ঐতিহাসিক ভূগোলের যে-পরিচয় লাভ করেছিলাম, তা ছিল এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা।
চট্টগ্রামে ফেরাটা ছিল খুব আবেগময় ব্যাপার। আমরা ক্যাম্পাসে পৌঁছেছিলাম প্রত্যাশিত সময়ের অনেক পরে। তখনো অধ্যাপক থেকে পিয়ন পর্যন্ত সবাই অপেক্ষা করছেন আমাদের অভ্যর্থনা জানাবেন বলে। আমরা উঠলাম উপাচার্যের বাসভবনে। ওই বাড়িতেই ক্যাম্পাসের সর্বশেষ রাত কাটিয়েছিলাম ড. মল্লিক ও আমি। আমার আবাসের অনেক কিছু লুষ্ঠিত হয়ে গেছে। কাপড়-চোপড়, হাঁড়ি-বাসন, বিছানা-বালিশ গেছে–তবে লুটেরারা একটি কফি সেট এবং তিনটি প্লেট (বোধহয় আমার, বেবীর ও রুচির জন্যে) রেখে গেছে। বইপত্র কিছু ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে মেঝেতে, কিন্তু আসবাবপত্র সব আছে, রেফ্রিজারেটর অক্ষত, কেবল গ্যারাজের ওপরের ঘরে সাত্তারের চৌকিটা নেই। কিছু লুঠপাট যে নিম্নশ্রেণির কর্মচারীরা করেছে, সে-খবর পাওয়া গেল, এমনকি চৌকিটা কে নিয়েছে তাও জানা গেল। সে অবশ্য বললো, পাছে লুঠ হয়ে যায়, তাই নিজের কাছে নিয়ে রেখেছে, আমি বললেই ফেরত দিয়ে যাবে। আমি বলেছিলাম, তবে চৌকি ফেরত পাইনি। তার নতুন মালিক পরে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ইউনিয়নের নেতা হয়েছিল।