জনসভায় এত লোক, কিন্তু কোনো বিশৃঙ্খলা নেই কোথাও। সভাশেষে শেরওয়ানি-টুপি-পরা এক ভদ্রলোককে কিছু ছেলে ঘিরে ধরেছিল–পরিচয় জানতে চায়, তার প্রমাণ চায়। শেষ অবধি অবশ্য বিনা গোলযোগেই ছেড়ে দিলো তাকে। এত মানুষের সুশৃঙ্খল আচরণ দেখে ভরসা হলো, আমরা ব্যর্থ হবো না, এত ত্যাগ বিফল হবে না।
রাত একটু গম্ভীর হলে মাহবুবের মা এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের আমার গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে চললাম মিরপুরের দিকে। ওই রাতে তরুণ অস্ত্রধারীদের অধিকাংশই বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তনে আনন্দ-উল্লাসে ব্যস্ত। পাড়ায় তাদের উপস্থিতি লক্ষ করা যাচ্ছে না। এই সুযোগে আশ্রয়প্রার্থীদের নিয়ে নিরাপদে বের হওয়া গেল। মিরপুরের কাছাকাছি গিয়ে সকল ইন্দ্রিয় সজাগ করে রাখলাম, নিজের নিরাপত্তার চিন্তা মনে এলো। এক জায়গায় ভারতীয় সেনারা গাড়ি থামিয়ে গন্তব্য জানতে চাইলেন। ব্যাখ্যা করলাম। তারা আমাকে যেতে দিলেন, তবে বড়ো রাস্তা ছেড়ে ভেতরে যেতে নিষেধ করলেন। বড়ো রাস্তার ওপরেই যাত্রীদের নামিয়ে দিলাম। আর ভেতরে ঢুকতে সাহস হচ্ছিল না, ওঁরাও ব্যাপারটা বুঝলেন বলে মনে হলো।
বাড়ির সামনে পৌঁছে দেখি, দোতলার বারান্দায় ওই মধ্যরাত্রিতে উৎকণ্ঠিতচিত্তে আব্বা এবং আর সবাই দাঁড়িয়ে–আমার নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের প্রতীক্ষায়।
পরদিন ড. কামাল হোসেন ও তাঁর স্ত্রী-কন্যাদের সঙ্গে দেখা করতে ছুটলাম ধানমন্ডিতে জিয়াউল হকের (টুলু) বাড়িতে। বন্দিদশা থেকে কামাল মুক্তি পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর মুক্তিলাভের একদিন পরে, তবে লন্ডন হয়ে ঢাকায় ফিরেছেন একই সঙ্গে। টুলু ভাইয়ের বাড়িতে কামাল ছিলেন না, তবু লোকে লোকারণ্য। এক ফাঁকে হামিদার সঙ্গে কুশলবিনিময় করে চলে এলাম।
ফাঁকে ফাঁকে যাচ্ছি শহীদ শিক্ষক ও সহকর্মীদের বাড়িতে, দেখা করছি মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, আনোয়ার পাশা, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, রাশীদুল হাসান, ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা, সিরাজুদ্দীন হোসেন, শহীদুল্লা কায়সারের পরিবারের সঙ্গে। যখন ফিরে আসছি তাদের কাছ থেকে, দেশটাকে স্বজনহারানো শ্মশান বলেই মনে হচ্ছে।
২.
জানুয়ারির ১১ তারিখ সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তখনই জানলাম, পরদিন বঙ্গবন্ধু দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। রাষ্ট্রপতি কে হচ্ছেন, জিজ্ঞাসা করায় তাজউদ্দীন বললেন, কালই জানতে পারবেন।
সংসদীয় পদ্ধতির সরকার যেখানে আমাদের অভীষ্ট, সেখানে বঙ্গবন্ধুর প্রধানমন্ত্রী হওয়াই স্বাভাবিক ও সংগত। তিনি রাষ্ট্রপতি থাকলে পাকিস্তানের সূচনাকালের মতো মন্ত্রিসভার চেয়ে রাষ্ট্রপ্রধানের প্রভাব ও ক্ষমতা থেকে যেত বেশি, তা সংসদীয় গণতন্ত্রের অনুকূল হতো না। দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে তারই উচিত হাল ধরা। তাজউদ্দীন নানা গুণে গুণান্বিত মানুষ, কিন্তু বাংলাদেশের। অগুনতি সমস্যার মোকাবেলায় তিনি প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পেতেন না। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কোনো কোনো রাজনৈতিক দল তখন সর্বদলীয় সরকার গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন। তার উল্লেখ না করেই তাজউদ্দীন ঘোষণা দেন যে, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে, সেপ্টেম্বর মাসে গঠিত, সর্বদলীয় উপদেষ্টা-পরিষদ স্বাধীনতালাভের পরেও বহাল থাকবে। উপদেষ্টা-পরিষদের কোনো নির্বাহী ক্ষমতা ছিল না, তাই তাঁদের বহাল থাকার বিষয়টা সর্বদলীয় সরকার গঠনের আহ্বান যাঁরা জানাচ্ছিলেন তাঁদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি। কিন্তু দেখা গেল, আওয়ামী লীগের তরুণ কোনো নেতা, প্রধানমন্ত্রীর অজান্তেই, সর্বদলীয় সরকার গঠনের প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বিবৃতি দিয়ে বসলেন। এতে পরিস্থিতি ঘোলাটে হলো মাত্র। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকল দলের প্রতিনিধি নিয়ে জাতীয় সরকার গঠিত হতে পারত, কিন্তু আওয়ামী লীগের বাইরের কেউই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ছিলেন না। সংসদীয় গণতন্ত্রের হিসেবে বিষয়টি প্রণিধানযোগ্য, আবার মুক্তিযুদ্ধকে বিপ্লব হিসেবে গণ্য করলে ওই প্রশ্ন গৌণ হয়ে যায়। তবে এ কথা তো সত্য যে, মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই জনসাধারণের নির্বাচিত দল বলেই আওয়ামী লীগের দেশ শাসনভারলাভের যৌক্তিকতা তুলে ধরা হয়েছিল।
ওদিকে মুজিব বাহিনী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের নেতারা বিবৃতি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন যে, তাঁরা মুজিব বাহিনীর অস্তিত্ব বজায় রাখবেন এবং অস্ত্র বা গোলাবারুদ সমর্পণ করবেন না। তাজউদ্দীন যদিও তার আগেই বলেছিলেন যে, মুক্তিযোদ্ধাদের নিরস্ত্র করার প্রশ্ন ওঠে না, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধকালীন ঘটনাপ্রবাহের পরিপ্রেক্ষিতে মুজিব বাহিনীর ওই ঘোষণা তাঁর সরকারের প্রতি বিরূপতার প্রকাশ বলেই মনে হয়েছিল। মন্ত্রিসভার দু দফা সম্প্রসারণ ঘটেছে–পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব খন্দকার মোশতাক আহমাদের কাছ থেকে নিয়ে দেওয়া হয়েছে আবদুস সামাদ আজাদকে, তাতে মোশতাক খুশি হননি।
যুদ্ধাপরাধীদের আর তাদের দোসরদের বিচারের দাবি প্রবল হচ্ছে, সরকারের তরফ থেকেও তেমন বিচারের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন কোনো কোনো মন্ত্রী। বাংলাদেশ মুক্ত হওয়ার পরে কলকাতায় বসে এ-বিষয়ে তাজউদ্দীন আমাকে যা বলেছিলেন, আমার মনে পড়ছে সেসব কথা : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে চাপ দিচ্ছে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে আর ভারতকে চাপ দিচ্ছে যুদ্ধবন্দিদের ছেড়ে দিয়ে উপমহাদেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে। যুদ্ধবন্দিদের বিচারে সোভিয়েত ইউনিয়ন ইচ্ছুক নয়, ভারতও উৎসাহী নয়। এই অবস্থায় কার জোরে আপনি বিচার করবেন? আর মূল অপরাধীদের বিচার করতে না পারলে তাদের সহযোগীদের বিচারের প্রক্রিয়া দুর্বল হয়ে যেতে বাধ্য। সেদিন আমি খুব হতাশ হয়েছিলাম, তবু আশা ছাড়িনি যে, যুদ্ধাপরাধী ও দালালদের বিচার হবে।