স্বামীবাগ থেকে এলাম ঠাটারিবাজারে–পিতৃগৃহে। দেখি, একতলা লোকে লোকারণ্য। পাড়ার বেশ কয়েকটি এবং পাড়ার বাইরের একটি অবাঙালি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে আমাদের বাড়িতে। আমরা ফিরে এসেছি জেনে, মনে হয়, তাদের দুশ্চিন্তা কিছু বেড়েছিল।
এই ন মাসের অনেকটা সময় আমার ছোটোভাই আখতারকে পালিয়ে থাকতে হয়। আখতারের একটা ছোটো প্রেস ছিল বাড়ির নিচতলায়। নির্বাচনের সময় থেকে আওয়ামী লীগের স্থানীয় কমিটি সেই প্রেসে অনেক কিছু ছাপিয়েছিল। রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত না হলেও, অনেকের মতো, আখতারও ওই সময়টায় এবং অসহযোগ আন্দোলনের কালে ঝুঁকেছিল আওয়ামী লীগের দিকে। এপ্রিলের ১ তারিখে তার প্রথম সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরপরই পাড়ার কিছু অবাঙালি লোকজন তার বিরুদ্ধে লেগে যায়। এলাকার মুরুব্বি হিসেবে আব্বা তাদের কোপানল এড়াতে সমর্থ হলেও আখতারকে পালিয়ে যেতে হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে সে বাড়ি ফিরে আসে।
আমাদের বাড়ির পাশেই ছিল এক পূজামণ্ডপ। তার পাশের বাড়িটা বিহারিদের। সে-বাড়ির সকলেই আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন, কিন্তু আখতারেরই প্রায় সমবয়সী, সে-বাড়ির বড়ো ছেলে, মাহবুব ১৬ ডিসেম্বরের পরে ভয়ে পালিয়ে যায়। তার মা নিরুদ্দিষ্ট পুত্রের জন্যে কেবল অশ্রুবিসর্জন করেন।
আব্বার সঙ্গে দেখা হলো এক বছর পরে। আখতারের ছেলেকে প্রথম দেখলাম তার ন মাস বয়সে। আব্বা বললেন, স্বাধীন বাংলা বেতার-কেন্দ্র থেকে যেদিন তিনি শোনেন যে, ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাকারী বাংলাদেশের শিক্ষক প্রতিনিধিদলে আমি ছিলাম, সেদিন নিজেদের নিরাপত্তার জন্যে ভয় না পেয়ে তাঁর বরঞ্চ খুব গর্ব হয়েছিল এই ভেবে যে, তার ছেলে দেশের জন্যে কিছু করছে। আব্বার বয়স তখন ৭৪। আমাদের বাড়ির মধ্যে পাকিস্তানি সৈন্যেরা যে গুলি চালিয়েছিল, সেই গুলিতে আহত আব্বার কমপাউনডার এরফান যে এখনো পঙ্গু, প্রতিবেশীদের একজনকে পাকিস্তানি সেনারা যে গুলি করে রাস্তায় ফেলে রেখে তার লাশ সরাতে নিষেধ করেছিল, তারপর বাঙালিরা সকলেই যে পাড়া ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন, আব্বা এসব বৃত্তান্ত জানালেন।
৯ তারিখ সকালে এলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ-প্রাঙ্গণে। অনেক বন্ধু ও সহকর্মীর সঙ্গে দেখা হলো : বাংলার রফিকুল ইসলাম ও মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, সমাজবিজ্ঞানের সাদউদ্দিন, গণিতের শহীদুল্লাহ্। আমাদের বন্ধু ও গিয়াসউদ্দিনের ভগ্নিপতি নুরুল হক তো ছিলেনই, আরেক বন্ধু মসিহুর রহমানও ছিল। যাদের লাশ কিংবা মরদেহের অংশবিশেষ পাওয়া গিয়েছিল, তাদের জানাজা হলো, তারপর মসজিদ-প্রাঙ্গণে গোর হলো। আমার দুই শিক্ষক মুনীর চৌধুরী ও মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর দেহাবশেষ পাওয়া যায়নি। সহকর্মী আনোয়ার পাশা, রাশীদুল হাসান ও আবুল খায়েরের লাশ পাওয়া গিয়েছিল। সবকিছুর শেষে প্রায় সবাই যখন চলে গেলেন, তখন আমি গিয়াসের কবরের পাশে বসে পড়ে কেঁদে ফেলি। বন্ধুরা কেউ কেউ আমাকে ধরে উঠিয়ে নিয়ে যান।
ওই সন্ধ্যায়ই দেখা করতে যাই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। তখন বোধহয় তিনি দেশের সবচাইতে ব্যস্ত মানুষ–সেই ব্যস্ততার মধ্যেও কথা হলো। আমি আগে আসিনি বলে অনুযোগ করলেন না, তবে তার বিচিত্র অনুভূতির কিছুটা তুলে ধরলেন আমার কাছে : দেশের সমস্যার বিপুলতা, পুনর্বাসন প্রয়াসের প্রাথমিক সাফল্য, বেআইনি অস্ত্রের ভয়, দেশের মানুষের প্রত্যাশার সঙ্গে বাস্তব অবস্থার বৈপরীত্য, প্রশাসন ও দলের মধ্যে তাঁর অনভিপ্রেত কাজ, বঙ্গবন্ধুর মুক্তিতে স্বস্তি, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উৎকণ্ঠা ও সংশয়।
আমি নিজেই দেখলাম, অস্ত্র নিয়ে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে কতোজন, নবাবপুরে-ঠাটারিবাজারে দোকানপাট লুঠ হচ্ছে–পুলিশের সাহায্য চেয়েও পাওয়া যাচ্ছে না। থানা বলছে, পাঠাবার মতো পুলিশ নেই সেখানে। কয়েকদিন পরে গিয়েছিলাম বেগম সুফিয়া কামালের বাড়িতে। তাঁদের লনে বসে কামাল ফুপা ও আমি কথা বলছি–এমন সময়ে পাশের বাড়িতে হইচই। ফুপা ও আমি এক দৌড়ে সেখানে হাজির হলাম। দেখি, কয়েকজন অস্ত্রধারী তাদের বাড়ির জিনিসপত্র লুঠ করছে। তারা দাবি করলো, তারা মুক্তিযোদ্ধা। আমি ফুপার পরিচয় দিয়ে ভাবলাম, কাজ হবে। কিছুই হলো না। তারা আমাদের বাধা-নিষেধ অনুনয়-বিনয় কিছুই মানল না। ওই বাড়ির বাসিন্দারা পুরোপুরি না হলেও অংশত অবাঙালি ছিলেন। অতএব তাদের সম্পত্তি লুঠ করার অধিকার অর্জন করেছে তথাকথিত ওই মুক্তিযোদ্ধারা। যখন আমি তাদেরকে বললাম আমার সঙ্গে নিকটবর্তী মুক্তিযোদ্ধা-ক্যাম্পে যেতে, তারা বললো, আমাদের কাজ আমরা করছি, আপনি যেখানে ইচ্ছা যেতে পারেন।
আমাদের বাড়ির আশ্রয়প্রার্থীরা সময় ও সুযোগমতো চলে যেতে শুরু করলেন। মাহবুবের মা আমার সাহায্যে যেতে চান মিরপুরে–আত্মীয়ের বাড়িতে। বিহারি-অধ্যুষিত অঞ্চলে আমার যাওয়াটা বাড়ির কারো অভিপ্রেত নয়। তবু কথা দিলাম, পরদিন নিয়ে যাবো।
১০ তারিখে সূর্যোদয় হলো অনেক প্রত্যাশা নিয়ে। এদিনে বঙ্গবন্ধু ফিরে আসবেন। প্রথমে ভেবেছিলাম, বিমানবন্দরের দিকে যাবো। পরে ভাবলাম, বেতারেই বরঞ্চ শুনি তাঁর প্রত্যাবর্তনের ধারাভাষ্য, তারপর যাবো তার জনসভায়। তাই করলাম। ৭ মার্চ ঢাকায় ছিলাম না, কিন্তু ১০ জানুয়ারির মতো বড়ো সমাবেশ আমি কখনো দেখিনি। বঙ্গবন্ধুকে দেখলাম দূর থেকে। তিনি যেন এই ক মাসে খানিকটা কৃশ হয়েছেন, কিন্তু কণ্ঠের তেজ বিন্দুমাত্র কমেনি। বক্তৃতায় তিনি জানিয়ে দিলেন ভুট্টোকে : কোনো বন্ধন নয় আর পাকিস্তানের সঙ্গে; বাংলাদেশ স্বাধীন, এর রাষ্ট্রীয় নীতি-ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র।