গুলি চলে বারোটা-সাড়ে বারোটায়। সারা শহরের মানুষ বিক্ষুব্ধ। বিকেল নাগাদ দৈনিক বাংলা এই খবর দিয়ে বের করে টেলিগ্রাম। খবর, প্রতিক্রিয়া আর ছবি। সরকারি ভাষ্য তখনো পাওয়া যায়নি। পরদিনের সংবাদপত্রে তা বেরিয়েছিল। সেই গতানুগতিক ব্যাখ্যা। বিদেশি দূতাবাসের দপ্তর রক্ষা করতে, আক্রান্ত পুলিশ আত্মরক্ষা করতে নিরুপায় হয়ে গুলি ছুঁড়েছে। বঙ্গবন্ধু দুঃখ প্রকাশ করলেন, বিচারবিভাগীয় তদন্তের আশ্বাস দিলেন। কিন্তু তখনই যে তদন্তের ভার কোনো বিচারপতিকে দেওয়া হয়েছিল, এমন মনে পড়ে না।
প্রতিবাদে সি পি বি, ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়ন হরতাল আহ্বান করে ৩ জানুয়ারিতে। মওলানা ভাসানী এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দল নিন্দাজ্ঞাপন করেন। ৩ তারিখে পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উলটোদিকের গোল চত্বরে স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয় (ফলকটি এখনো আছে, অনাদরে ধুলো সঞ্চয় করেছে বছরের পর বছর ধরে; তবু আছে, এই যা)। শিল্পী-সাহিত্যিকদের পক্ষ থেকে প্রতিবাদসভা আহ্বান করেন সুফিয়া কামাল, জসীমউদ্দীন, রণেশ দাশগুপ্ত, সন্তোষ গুপ্ত, শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, কামরুল হাসান, (স্থপতি) মাজহারুল ইসলাম, সরদার ফজলুল করিম, সজীদা খাতুন, জাহেদুর রহিম, সৈয়দ হাসান ইমাম, কায়সুল হক, আলী আকসাদ, আবদুল হালিম, বজলুর রহমান (আপসো), সাইফুদ্দৌলা (ছায়ানট), ইকরাম আহমদ (উদীচী), আরিফুল হক (আমরা কজন)। এঁদের আহ্বানে সমাবেশ হয়, মিছিল হয়।
প্রথমে মনে হয়েছিল, সরকার নিজের ভুল ধরতে পেরেছে। মন্ত্রীরা কেউ কেউ নিহতদের পরিবারকে সহানুভূতি জানাতে গেলেন, দুঃখপ্রকাশ করে বিবৃতি দিলেন। তারপরই সরকারদলীয় রাজনৈতিক নেতা, যুবনেতা, ছাত্রনেতাদের কণ্ঠে নিঃসৃত হলে কঠোর ভাষায় সাবধানবাণী। তারা জানালেন, বঙ্গবন্ধুর কুৎসা জাতি সহ্য করবে না, এই ঘটনাকে উপলক্ষ করে কাউকে ফায়দা লুঠ করার সুযোগ দেওয়া হবে না, চক্রান্ত বরদাশত করা হবে না। হাসান হাফিজুর রহমান তখন দৈনিক বাংলার সম্পাদক, তোয়াব খান তার নির্বাহী সম্পাদক। সরকার নিয়ন্ত্রিত পত্রিকা প্রশাসনযন্ত্রের ঘটানো ঘটনার নিন্দা করে টেলিগ্রাম বের করেছে, তা গণ্য হলো শোচনীয় বলে এবং তার সম্পূর্ণ দায়িত্ব গিয়ে পড়ল ওই দুজনের ওপরে। ৬ তারিখে উভয়েই দৈনিক বাংলা থেকে অপসৃত হলেন। নুরুল ইসলাম পাটোয়ারী নিযুক্ত হলেন পত্রিকার সম্পাদক ও প্রশাসক। পত্রিকার সব বিভাগের কর্মীরা প্রতিবাদ করলেন, তাঁদের প্রতিনিধিরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ওই আদেশ প্রত্যাহারের আবেদন জানালেন। বঙ্গবন্ধু তাদের অনুরোধ বিবেচনার আশ্বাস দিলেন, কিন্তু হুকুম নড়ল না। তোয়াবকে নেওয়া হলো সরকারে আর খানিকটা দেরি করে হাসানকে পাঠানো হলো মস্কোতে, আমাদের দূতাবাসে প্রেস কাউনসেলর করে।
১৮.
সেই যে বিনা পরীক্ষায় পরবর্তী শ্রেণিতে উন্নীত করে দেওয়া হলো। ছাত্রছাত্রীদের, তার ফল আমরা অচিরেই ভোগ করতে শুরু করলাম। ১৯৭২ সালের মার্চ মাসেই ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকে দাবি উঠলো সিলেবাস কমানোর। উঠবে নাই বা কেন? আগের ক্লাসের পড়া যে শেখেনি, পরীক্ষাগারে নির্ধারিত পরীক্ষা করেনি, পরের ক্লাসের পড়া কিংবা বিজ্ঞানের ব্যবহারিক পরীক্ষা তার কাছে তো দুরূহ মনে হবেই। এর প্রতিকার না-পড়া বিষয় জেনে নেওয়া নয়–সেই সময় ও সুযোগ কারো নেই–প্রতিকার আরো না-শেখা। অতএব, সিলেবাস সংক্ষিপ্ত করার আন্দোলন শুরু হলো। প্রথম-প্রথম কেউ গা করেননি এতে, কিন্তু দেখা গেল ছাত্রেরা না-শেখার পণ করেছে। মাস ছয়েক পরে ছাত্র হিতৈষী শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্থির করলো, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির পাঠ্যসূচি অর্ধেক করে দেওয়া হবে। জয়ধ্বনি করতে করতে আন্দোলনকারী ছাত্রেরা ক্লাসে ফিরে গেল। ওদিকে গণপরীক্ষার ফলও সেবার হলো খুব সন্তোষজনক। অত উচ্চহারে পাশ এর আগে আর দেখা যায়নি, কারণ পরীক্ষার্থীরা বেশ স্বাধীনভাবে পরীক্ষা দিয়েছে।
১৯৭০ সালে একবার ডিগ্রি পরীক্ষা কেমন চলছে, তা দেখতে বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে আমরা কজন শিক্ষক গিয়েছিলাম চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন পরীক্ষাকেন্দ্রে। আমাদের অভিজ্ঞতা ভালো হয়নি। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে পরীক্ষার্থীরা আমাদের কাজকর্মে এতই ক্ষুব্ধ হয়েছিল যে, অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার শাহেদ লতিফের দৃষ্টি এদিকে আকর্ষণ করতে বাধ্য হয়েছিলাম। এবারো ওই কাজে অভিজ্ঞতা ভালো হলো না। ভিক্টোরিয়া কলেজের বাংলার শিক্ষক আলী আসগর ভুইয়া যে-গল্প শুনিয়েছিলেন, তা-ই ছিল এবারকার সেরা সঞ্চয়। পরীক্ষার খাতায় যে-রচনা লিখেছে এক পরীক্ষার্থী–সম্ভবত সে পরীক্ষার্থিনী–তার শেষ বাক্য ছিল : তুমি লিখিয়া সুফিয়াকে দিবে। অর্থাৎ বাইরে থেকে যিনি নকল সরবরাহ করেছিলেন, তিনি। প্রচুরতম লোকের প্রভূততম হিতসাধনের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে সেই কাগজটি যাতে আরো একজন পায়, তার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রথম প্রাপক সেই নির্দেশ প্রেরিত রচনার অংশ বিবেচনা করে সেটাসুদ্ধ লিখে দিয়েছে। দ্বিতীয় গল্পটি ছিল এক পরীক্ষার্থীকে নিয়ে, যে পরীক্ষাগৃহ থেকে বেরিয়ে শৌচাগারে গেছে সেখানে রেখে-আসা বইপত্র দেখে আসতে। তত্ত্বাবধায়ক তা টের পেয়ে পিয়ন পাঠিয়েছেন তাকে ধরে আনতে। দরজায় ধাক্কা দিয়ে ব্যর্থ হয়ে পিয়ন ফিরে এলো। তত্ত্বাবধায়ক তাকে দিয়ে এবারে বলে পাঠালেন, পরীক্ষার্থী বেরিয়ে না এলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ছেলেটি গজগজ করতে করতে বেরিয়ে এলো : গোলমালে-গোলমালে সারা বছরটা কেটে গেল, এখন যে একটু পড়াশোনা করে পরীক্ষা দেবো–তারও উপায় নেই।