এখানে একটি শোনা কথা বলি–কাগজপত্র যাচাই করে নিতে পারলে ভালো হতো। ১৯৭০-৭১ সালের পূর্ব পাকিস্তানের বাজেটে মাদ্রাসা শিক্ষা খাতে যে বরাদ্দ ছিল, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে প্রণীত ১৯৭১-৭২ সালের বাজেটে তা বৃদ্ধি করা হয়। ১৯৭২-৭৩ সালের বাজেটের খসড়া প্রণয়নের সময়ে মাদ্রাসা শিক্ষাখাতে বরাদ্দ ১৯৭০-৭১ সালের স্তরে ফিরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা হয়েছিল। পরে রাজনৈতিকভাবে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, অব্যবহিত পূর্ববর্তী অর্থবছরের বরাদ্দের চেয়ে তা কমানো যাবে না। সুতরাং যথাপূর্বং তথাপরং।
বাজেট-বক্তৃতা-রচনায় সাহায্য করতে গিয়ে তখন একটি বিষয় উপলব্ধি করি। তা হলো, পরিকল্পনা কমিশনের সঙ্গে সরকারের অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের আমলাদের বিরোধ। পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান ও সদস্যদের মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা কিংবা অনেক কর্মকর্তার সচিবের পদমর্যাদা এবং তাঁদের সার্বিক কর্তৃত্ব উচ্চপদস্থ বেসরকারি আমলাদের পছন্দ ছিল না। ভেতরে হয়তো আর কিছু ছিল। মহীউদ্দীন খান আলমগীর তখন সিভিল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক, তার শিক্ষক নূরুল ইসলাম আমার সামনেই তাকে বলেছিলেন, সিভিল সার্ভিস বনাম পরিকল্পনা কমিশনের অকারণ এই বিরোধ মীমাংসার জন্যে উদযোগ নিতে পারো না? তিনি তাদের সমিতির সভাপতি সৈয়দ আবুল খায়েরের সঙ্গে এ-বিষয়ে আলোচনায় বসতে রাজি।
বাংলাদেশ সার্বিক সমস্যার মধ্য দিয়ে পথ চলছিল। বড় বড় সমস্যার মধ্যে কত ছোটো ছোটো সমস্যা লুকিয়ে থাকে, বাইরে থেকে তা বোঝা যায় না।
প্রথম বাজেট-বক্তৃতার কাজ শেষ হওয়ার পরে নূরুল ইসলাম আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার বাংলা ভাষ্য দেখে দেওয়ার। অবশ্য এক্ষেত্রে পরিকল্পনা কমিশনই পুরো পরিকল্পনার বাংলা ভাষ্য তৈরি করে দেন। একাধিক হাতের রচনা হওয়ায় তাতে অল্পস্বল্প অসংগতি থেকে যায়। চট্টগ্রামে বসেই আমি পাণ্ডুলিপি দেখে দিই। খুব বেশি যে কিছু করেছিলাম, তা নয় সময়ও ছিল খুব সংকীর্ণ। তবু ওই দলিলের সঙ্গে আমার একটা সংযোগ ছিল, তা ভাবতে ভালো লাগে।
এখানে আরেকটি উদ্যোগের কথা বলে রাখি। বাংলাদেশ ব্যাংকের চট্টগ্রাম শাখার দুই কর্মী স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে ব্যাংকের ফরম বাংলায় অনুবাদ করতে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। এজন্যে কোনো পারিশ্রমিক তারা পেতেন না। প্রতি রোববার তারা আমাকে তাদের অনুবাদ দিয়ে যেতেন, পরের রোববারে নিয়ে যেতেন। শহর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়-ক্যম্পাসে আসা-যাওয়ার জন্যে কেবল তারা অফিসের গাড়ি ব্যবহার করতে পারতেন। আমাকে যে-কোনো সম্মানী দেওয়া যাচ্ছে না, তা নিয়ে তাঁদের কুণ্ঠার অবধি ছিল না। তারা যে-মনোভাব থেকে কাজে নেমেছিলেন, সেই মনোভাব থেকে আমিও তাদের সহযোগিতা করেছিলাম। আমার পরামর্শ যদি তাঁদের কাজে লেগে থাকে, তবে তাদের কাছ থেকে আমিও কিছু শিখেছিলাম। তবে প্রকৃতই মুগ্ধ হয়েছিলাম তাদের নিষ্ঠায়।
১৬.
১৯৭২ সালের ২৭ আগস্ট ঢাকায় অধ্যাপক এ এফ এম নূরুল ইসলামের ক্লিনিকে আমার পুত্রের জন্ম হয়। সবাই খুশি। ওর নাম আনন্দ রাখায় আমার আব্বা বেশ সন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি কলকাতার সিটি স্কুলের ছাত্র ছিলেন, সেই সূত্রে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের প্রথম সভাপতি এবং ওই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা আনন্দমোহন বসুর প্রতি তাঁর প্রগাঢ় শ্রদ্ধা ছিল। তিনি বললেন, র্যাংলারের নামে ওর নাম রেখেছ, বড় হয়ে বিদ্বান হবে। বিদ্যার প্রতি আনন্দের যে বিশেষ অনুরাগ হয়েছে, তা নয়, তবে ওর সব পরীক্ষার ফলাফল ভালো এবং এ-পর্যন্ত সে তিনটি মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেছে–একটি বিদেশি। তবে তা নামমাহাত্মের ফল নয় নিশ্চয়।
১৭.
বাংলাদেশের জন্যে ১৯৭৩ সালের সূচনাটা ভালো হয়নি। ১ জানুয়ারি ঢাকায় ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশ গুলিবর্ষণ করে, প্রাণহানি ঘটে।
যখন মনে হয়েছিল ভিয়েতনামের যুদ্ধ শেষ হয়ে আসছে, প্যারিসে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন শুরু হতে যাচ্ছে শান্তিপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, তখনই ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভয়াবহ বোমাবর্ষণ করে উত্তর ভিয়েতনামে। তারই প্রবল প্রতিবাদ হয়েছিল বাংলাদেশে। বাংলাদেশ সরকারও এই বোমা হামলার নিন্দা করেছিলেন। সবাইকে জানিয়েই বিক্ষোভ মিছিল আয়োজিত হয় ঢাকায়। তার নেতৃত্বে ছিল কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-কর্মীরা। পুরানা পল্টনের দিক থেকে তোপখানা রোড ধরে মিছিল অগ্রসর হয়। প্রেস ক্লাবের উলটোদিকে ছিল ইউ এস আই এসের দপ্তর। বিক্ষোভকারীরা ইট-পাটকেল ছুঁড়েছিল সেই দপ্তর লক্ষ করে। তখনই পুলিশ গুলি চালায়। সঙ্গে সঙ্গেই মারা যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দর্শন। বিভাগের ছাত্র মতিউল ইসলাম এবং ঢাকা কলেজের ছাত্র মীর্জা কাদের। আহত হয় প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-সংসদের সহ-সভাপতি আবুল কাসেম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র আমিরুল ইসলাম ও ইংরেজি বিভাগের ছাত্র ফরিদ হোসেন, কোনো স্কুলের ছাত্র পরাগ, দৈনিক বাংলার আলোকচিত্রী রফিকুর রহমান এবং হয়তো আরো কয়েকজন। স্বাধীন বাংলাদেশে এই প্রথম গুলি চলল মিছিলে। আমরা হতবাক, বিমূঢ়। ঘটনাক্রমে আমি সেদিন ঢাকায়। দিভ্রান্তের মতো একবার অকুস্থলে যাই, একবার যাই কামাল হোসেনের বাড়িতে। কামাল শোকার্ত ও ক্ষুব্ধ। তিনিও বলতে পারেন না, গুলি চালানোর নির্দেশ কে দিয়েছিলেন। কেউ আমলাদের দোষ দেয়। কিন্তু আমলাদের এত সাহস হবে, তা বিশ্বাস হয় না। প্রধানমন্ত্রী নাকি জানতেন না। তাহলে অন্তত মন্ত্রী-পর্যায়ে কেউ না কেউ এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব দিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তা বা ম্যাজিস্ট্রেটকে।