অর্থমন্ত্রীর বাজেট-বক্তৃতার একটা খসড়া মন্ত্রণালয় থেকে করে দেওয়া হতো। প্রথম বছরে খসড়াটা ছিল ইংরেজিতে, পরের দুবার ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর তার বাংলা ভাষ্য তৈরি করে রেখেছিল। আমি প্রথমবার সেটা অনুবাদ করেছি, পরের দুবার বাংলা ভাষ্য খানিকটা সরল করেছি। তারপর অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন এবং পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান অধ্যাপক নূরুল ইসলাম একযোগে এসে তাতে কিছু যোগ-বিয়োগ করেছেন। আমি অন্যত্র বলেছি, বাংলা ও ইংরেজি দুটো ভাষাই তাজউদ্দীন খুব ভালো জানতেন। বাক্যগঠনে ও শব্দপ্রয়োগে একটু খুঁতখুঁতেই ছিলেন তিনি। জুতসই শব্দ না পাওয়া পর্যন্ত কিংবা মনমতো বাক্য গঠন না হওয়া পর্যন্ত তিনি পরবর্তী বাক্যে যেতে চাইতেন না। বিষয় ও ভাষা উভয় ক্ষেত্রেই তাঁর মনোযোগ ছিল সম্পূর্ণ। অধ্যাপক নূরুল ইসলাম বিষয়ের দিকে খেয়াল রাখতেন, মাঝে মাঝে বাংলা প্রতিশব্দের দুরূহতা সম্পর্কে নালিশ করতেন। আমার কাজ সম্পূর্ণ হলে ড. কামাল হোসেন বাজেট-বক্তৃতার ইংরেজি পাঠ তৈরি করতেন–খানিকটা মন্ত্রণালয়ের আদি খসড়ার সাহায্যে, বাকিটা তাজউদ্দীন, নূরুল ইসলাম ও আমার সঙ্গে আলোচনা করে। নূরুল ইসলাম একবার হাসতে হাসতে তাজউদ্দীনকে বলেছিলেন, আমরা এত ঘুরপথে যাই কেন? প্রথমে মিনিস্ট্রির ড্রাফট, তারপর ড. আনিসুজ্জামানের বাংলা, তারপর আমাদের সংশোধন, সবশেষে ড. কামাল হোসেনের ইংরেজি। প্রসেসটা আরেকটু ডাইরেক্ট করলে হয় না?
১৯৭২ সালে আমাদের জাতীয় সংসদ ছিল না। গণপরিষদে বাজেট উত্থাপনের কথা নয়। তাই বাংলাদেশের প্রথম বাজেট উপস্থাপিত হয়েছিল বেতার-টেলিভিশনে, পরে সংবাদ-সম্মেলনে যথারীতি এ-সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী। প্রথম বাজেট-বক্তৃতায় তিনি এজন্য দুঃখপ্রকাশ করেছিলেন এবং আশা পোষণ করেছিলেন যে, এরপর থেকে জনপ্রতিনিধিদের সামনেই বাজেট পেশ করা হবে। সে আশা বাস্তবে রূপ নিয়েছিল।
১৯৭২ সালের বাজেট-বক্তৃতার একটি কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল রাষ্ট্রায়ত্তকরণ। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বিশেষ বিশেষ শিল্প ও বাণিজ্যের রাষ্ট্রায়ত্তকরণের প্রতিশ্রুতি ছিল। তাছাড়া ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের একুশ দফায় এবং তার আগে-পরে নানা দলের ইশতেহারে কিংবা নানারকম সম্মেলনের প্রস্তাবে ব্যাংক, বীমা, চা ও পাট শিল্প প্রভৃতি রাষ্ট্রায়ত্তকরণের দাবি ছিল। এ নিয়ে বড় একটা আপত্তিও শোনা যায়নি। কিন্তু ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে যখন প্রধান প্রধান শিল্প রাষ্ট্রায়ত্ত হলো, তখন ‘গেল গেল’ রব পড়ে গেল এবং এই ব্যবস্থাগ্রহণের মধ্যে ভারতের স্বার্থ বা ইঙ্গিত আবিষ্কৃত হলো। সমালোচনা প্রবল হয় বাঙালি মালিকানাধীন শিল্প অধিগ্রহণ করায়। কিন্তু ব্যাংক-ব্যবস্থা রাষ্ট্রায়ত্ত করলে বাঙালি পরিচালনাধীন ব্যাংক তার থেকে বাদ দেওয়া কিংবা পাটশিল্প রাষ্ট্রায়ত্ত করলে বাঙালি মালিকানাধীন পাটশিল্প তার আয়ত্তের বাইরে রাখা তো সম্ভবপর ছিল না। রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদের বেশির ভাগই ছিল পাকিস্তান আমলের সরকারি উদ্যোগ এবং পাকিস্তানিদের পরিত্যক্ত সম্পত্তি–এক-চতুর্থাংশেরও কম ছিল বাঙালি উদ্যোক্তাদের সম্পদ। এসব কথা তখন আমরা আলোচনা করেছিলাম, সব যে বাজেট-বক্তৃতার অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল, তা নয়।
আরো একটি কথা সেদিন আলোচনায় এসেছিল। সমালোচকদের একটি বক্তব্য ছিল এই যে, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান চালানোর মতো দক্ষ জনশক্তি সরকারের নেই। তাজউদ্দীন ও নূরুল ইসলাম উভয়েই মনে করতেন যে, বেসরকারি অবস্থায় প্রতিষ্ঠান চালানোর মতো দক্ষ ব্যক্তি যদি দেশে থেকে থাকেন, তাহলে সেই প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রায়ত্ত করলে তাদের সাহায্যেই তা চালানো যেতে পারবে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে যদি বিদেশি বিশেষজ্ঞ আনাবার প্রয়োজন হয়, সরকারও তাহলে সে-কাজটি করতে পারে। এই নীতিই বাস্তবে অনুসৃত হয়েছিল। ফল হয়তো আশানুরূপ হয়নি। তার অনেক কারণও ছিল।
পরে শুনেছি, রাষ্ট্রায়ত্তকরণের বিষয়ে মন্ত্রিসভায় মতানৈক্য ছিল, কিন্তু এটি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অতএব পালনীয়, বঙ্গবন্ধুর এই যুক্তি খণ্ডন করা যায়নি। মুজিববাদ সম্পর্কে প্রশ্ন করায় বঙ্গবন্ধু একবার বলেছিলেন, তিনি রাষ্ট্রীয় চার নীতিতে বিশ্বাসী, আবার আলাদা করে বলেছিলেন, তিনি সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী। সমাজতন্ত্র বলতে তিনি ঠিক কী বুঝতেন, আমরা তা কখনো স্পষ্টভাবে জানতে পারিনি। তবে এক ধরনের সমতাভিত্তিক সমাজের স্বপ্ন তিনি দেখতেন। শিল্প-বাণিজ্যের রাষ্ট্রায়ত্তকরণের পাশাপাশি ভূমি সংস্কারের কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ১০০ বিঘা হবে জমির ব্যক্তিগত মালিকানার সীমা, খাসমহলের জমি ভূমিহীনদের বিতরণ করা হবে। এসবের কিছু কিছু কার্যকরতার খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু জমির ব্যাপারে আওয়ামী লীগের মধ্য থেকেই বাধা ছিল অনেক বেশি, কেননা তার সংস্কার ঘটলে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হতেন, তাঁদের মধ্যে ওই দলেরই লোকজন ছিলেন অধিক। তাই রাষ্ট্রায়ত্তকরণ শিল্প-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকে এবং তার পাশাপাশি বেসরকারি খাতে ছোটো ও মাঝারি ধরনের শিল্প বাণিজ্যের উদযোগ রাষ্ট্রীয়ভাবে উৎসাহিত করার সিদ্ধান্ত হয়। উৎসাহিত করার এই নীতির কথা প্রথম বাজেট-বক্তৃতায় ছিল।