৪ নভেম্বর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হলো। পাকিস্তানের সংবিধান তৈরি করতে লেগেছিল প্রায় নয় বছর, আমরা তা এক বছরের মধ্যেই পারলাম। এতে আত্মসন্তুষ্টির কারণ ছিল বই কী! একটা ভালো সংবিধান-রচনার জন্যে কামাল হোসেন দেশ-বিদেশের প্রশংসা পেয়েছিলেন, লর্ড ডেনিং তো উচ্ছ্বসিত ভাষায় একটি চিঠি লিখেছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতালাভের পরে নিজেদের যে ঐক্য নষ্ট হতে শুরু করেছিল, সংবিধান-রচনার সাফল্যও সে-ঐক্য রক্ষা করতে পারল না। গণপরিষদে সংবিধান বিল উপস্থাপনের ঠিক আগে মওলানা ভাসানী দাবি করলেন, গণপরিষদে উত্থাপনের আগে, জাতীয় সম্মেলন আহ্বান করে সেখানে সংবিধানের খসড়া আলোচনা করতে হবে। একই সময়ে আ স ম আবদুর রব ও শাজাহান সিরাজ বিবৃতি দিয়ে দাবি করলো, সংবিধান গণভোটে দিতে হবে। গণপরিষদে যখন খসড়া সংবিধানের আলোচনা চলছে, তখন, ২৩ অক্টোবরে, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের প্রতিষ্ঠা ঘটলো। আত্মপ্রকাশের মুহূর্তেই এটি হয়ে দাঁড়ালো বৃহত্তম বিরোধী দল। কাদের প্রেরণায় এবং কোন লক্ষ্যে এই নতুন রাজনৈতিক দল গড়ে উঠলো, এ-নিয়ে অনেক কানাঘুষো শোনা গেল। সরকার কী বুঝলো, জানিনা, কিন্তু মনে হয়, একটা শক্ত অবস্থান নিলো অর্থাৎ সহনশীলতার মাত্রা কমলো।
এদিকে সংবিধানে বলে দেওয়া হলো যে, সংবিধানের একটি নির্ভরযোগ্য বাংলা পাঠ ও একটি নির্ভরযোগ্য ইংরেজি পাঠ থাকবে এবং উভয় পাঠের মধ্যে বিরোধ ঘটলে বাংলা পাঠ প্রাধান্য পাবে। এতে একইসঙ্গে গৌরব ও দায়িত্বের বোধ জেগেছিল আমার, ভবিষ্যতের কথা ভেবে ভীতি ও শঙ্কার ভাবও যে জাগেনি, তাও নয়।
১৩.
নজরুল ইসলামকে ঢাকায় নিয়ে আসা হলো ১৯৭২ সালের ২৪ মে। উদ্যোগটা সম্পূর্ণতই বাংলাদেশ সরকারের। কলকাতা থেকে যাকে তারা সঙ্গে করে নিয়ে এলেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকায় ছিল আমাদের বন্ধু মোস্তফা সারোয়ার। বিমানবন্দরে এবং তার জন্য বরাদ্দ বাড়িতে বিপুল জনসমাগম হয়েছিল। পরদিন তাঁর জয়ন্তীও পালিত হয়েছিল জাঁকজমকের সঙ্গে। সরকারিভাবে কথাটা না বলা হলেও সবাই জানত যে, তিনি পাকাপাকিভাবেই এখানে থেকে যাবেন। তবু দ্রুত তাকে দেখার জন্যে মানুষের ছিল অদম্য উৎসাহ। সে-যাত্ৰা আমি তাকে দেখতে যেতে পারিনি। বস্তুতপক্ষে তাঁকে দেখতে গিয়েছিলাম বেশ দেরিতে, তাও বেশিক্ষণ থাকিনি–আমার খুব অস্বস্তিবোধ হচ্ছিল। যদিও কলকাতায় অসুস্থ কবিকে দেখতে গিয়েছি একাধিকবার, এবারে খারাপ লাগছিল বেশি। সে কি আমার অনুভূতি আগের চেয়ে তীক্ষ্ণ হয়েছে বলে, না তাঁকে দেখার কৌতূহল আগেই মিটে গিয়েছিল বলে? কলকাতায় একবার দেখেছি তাকে একান্তে–পারিবারিক পরিমণ্ডলে, আরেকবার বহুজনের মধ্যে–জন্মোৎসবের উদ্দীপনায়। এবারে উপলক্ষ ছাড়াই অনেক অনুরাগীর দলভুক্ত হয়ে তাঁকে দেখলাম। এখানে তার প্রাণধারণের উপকরণ উন্নত হয়েছে বটে, কিন্তু পারিবারিক পরিবেশ-রচনার প্রয়াস তত সফল হয়নি। পরে তাঁর জন্মদিনে তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে তার সম্পর্কে কিছু বলার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। কিন্তু যেভাবে সেদিন গাড়ি থেকে টেনে-হিঁচড়ে তাঁকে বাংলা একাডেমির সভামঞ্চে তোলা হয়েছিল, তা দেখার বেদনায় আমার সৌভাগ্যলাভের আনন্দ ম্লান হয়ে গিয়েছিল। সে-কথা যথাস্থানে।
১৪.
১৯৭২ সালের ৬ জুন। গণপরিষদ ভবনে বসে কাজ করছি। টেলিফোনে খবর পেলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের শিক্ষক, কবি হুমায়ূন কবির আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হুমায়ূন আমার সরাসরি ছাত্র ছিল। তার সাহিত্যচর্চা ও সমাজচিন্তা এবং মন ও মননের যেটুকু পরিচয় পেয়েছিলাম, তাতে আমি প্রীত হই। বইপত্র ঘটতে ও নিয়ে যেতে সে প্রায় আমার বাসায় আসত এবং সে-উপলক্ষে নানা বিষয়ে আলাপ-আলোচনা হতো। পরে তার কোনো আচরণে আমি বিরক্ত হয়েছিলাম এবং সেও তা টের পেয়েছিল। ফলে আমার সঙ্গে তার একটা দূরত্ব রচিত হয়। আমি যে-বছর চট্টগ্রামে চলে যাই–১৯৬৯ সালে–সে-বছরে সে এম এ পাশ করে। তারপর বাংলা একাডেমির বৃত্তি নিয়ে জীবনানন্দ দাশের কবিতা সম্পর্কে গবেষণায় প্রবৃত্ত হয়। সে বিয়ে করেছিল তার সহাধ্যায়ী, আমার প্রিয় ছাত্রী, সুলতানা রেবুকে। আমি চট্টগ্রামে থাকায় এ-সময়টায় তাদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। মৃত্যুর মাত্র কয়েক মাস আগে সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেয়।
হুমায়ূনের নিহত হওয়ার খবর পেয়ে তার বাড়ি যেতে চাইলাম। কিন্তু সেই মুহূর্তে পথ চিনিয়ে নিয়ে যেতে পারে, এমন কাউকে পাওয়া গেল না।
পরে শুনতে পাই, হুমায়ূন ছিল পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির একজন নেতা। সিরাজ শিকদারের সঙ্গে মতানৈক্য হওয়ায় সে দল থেকে সরে আসে। এ সময়েই, ১৯৭২ সালের গোড়ায়, সে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্ম গ্রহণ করে। তার পূর্বতন রাজনৈতিক সহকর্মীরা তা অনুমোদন করেনি। দলের জন্যে সে বিপজ্জনক বিবেচিত হয়। তাকে বাড়ির বাইরে ডেকে নিয়ে গুলি করে অজ্ঞাতপরিচয় আততায়ী।
হুমায়ূনের মৃত্যুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগে যে-শোকসভা হয়, তাতে যোগ দিয়েছিলাম। বিভাগের সহকর্মীদের সঙ্গে তখন আমার সম্প্রীতি অক্ষুণ্ণ। তাঁদের অনুরোধে হুমায়ূন সম্পর্কে আমিও দু-চারটি কথা বলি। তার অপমৃত্যুতে আমি প্রকৃতই গভীর শোক উপলব্ধি করেছিলাম।
১৫.
তাজউদ্দীন আহমদ আহ্বান জানালেন, তাঁর বাজেট-বক্তৃতা-প্রণয়নে সাহায্য করতে হবে। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এলাম। বিমানবন্দর থেকে অর্থমন্ত্রীর একান্ত সচিব আবু সাঈদ চৌধুরী আমাকে সরাসরি নিয়ে গেলেন রাষ্ট্রীয় অতিথিশালা ‘পদ্মা’য়। বাজেট পেশ না হওয়া পর্যন্ত সেখান থেকে আর বের হওয়া যাবে না। যে-তিন বছর তাজউদ্দীন বাজেট দিয়েছিলেন, সে-তিন বছরই আমি একবার করে সরকারি অতিথি হয়েছিলাম।