বিশ্ববিদ্যালয়ে যথারীতি পাঠদান চলে। ১৯৯৫ সালে বিভাগীয় সভাপতি হওয়ার নিয়োগপত্র পেলে ওই দায়িত্বগ্রহণে অপারগতা জানাই। তাতেও কিছু কটু কথা শুনতে হয় তাদের কাছ থেকে যারা এক সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ফিরে আসার বিরোধিতা করেছিল। পরে যখন ফিরে আসি, তখনো তা যথাসম্ভব বিলম্বিত করতে অনেকেই তৎপর ছিলেন, যাতে আমার অন্য কয়েকজন সহকর্মী অধ্যাপক পদলাভের জন্য প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতার কাল পূর্ণ করতে পারেন। হয়তো এসবের মূলে ছিল আমার বিভাগীয় প্রধান হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। ওই আসনে না বসাই ভালো বলে মনে হয়েছিল। নির্ঝঞ্ঝাট শিক্ষকতা করি আর মাঝে-মধ্যে এদেশ-সেদেশে সভাসমিতিতে যোগ দিতে যাই।
এই সভাসমিতিতে আমার যোগ দেওয়ার ব্যাপারটা অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের খুব অপছন্দ ছিল। উনি বলতেন, আপনি লেখালিখি করবেন নিজের প্ল্যান-অনুযায়ী, নিজের পছন্দের বিষয়ে। অন্যেরা সেমিনার-কনফারেনস করে, তাদের ফরমাইশ আপনি খাটতে যাবেন কেন? সারের এই তিরস্কার সত্ত্বেও বাইরে যাই। অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয়, অনেক বিষয়ে জানতে পারি, অভিজ্ঞতা বাড়ে, দৃষ্টিভঙ্গির কিছু উন্নতি হয়।
প্রবন্ধ পড়া বা বক্তৃতা করা ব্যতিরেকে বিদেশভ্রমণের সুযোগ হলো ২০০০ সালের এপ্রিলে। জার্মানির হ্যাঁনোফার শহরে এক্সপো ২০০০ অনুষ্ঠিত হবে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর উদ্যোগে বাংলাদেশের এক প্রতিনিধিদল গেল সেখানে। বাণিজ্য-সচিব গোলাম রহমান তার নেতা। বুয়েটের স্থাপত্যবিদ্যার অধ্যাপক সামসুল ওয়ারেস, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর পরিচালক ফরিদুল হাসান ও আমি তার সদস্য। বার্লিনের এক স্থপতির সহযোগিতায় সামসুল ওয়ারেস এক্সপোতে বাংলাদেশের প্যাভিলিয়ন নির্মাণের নকশা করে দিয়েছিলেন, আর সেখানে বাংলাদেশ-বিষয়ে যে-পুস্তিকা নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সেটার পাঠ দেখে দিয়েছিলাম আমি। দুর্ভাগ্যবশত পুস্তিকায় প্রকাশিত লেখাটি যেভাবে আমি সংশোধন করে দিয়েছিলাম, আমার এবং ব্যুরোর অজ্ঞাতেই শেষ পর্যন্ত তা উপেক্ষিত হয়। ফলে পুস্তিকাটির বক্তব্য যে-রূপ নেয়, তা স্পষ্টতই সরকারি নীতির সঙ্গে–এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের ধারণার সঙ্গে–মেলেনি। ব্যাপারটা প্রথম ধরা পড়ে জার্মানিতে আমাদের রাষ্ট্রদূত আনোয়ারুল মাসুদের কাছে। তিনি হ্যাঁনোফারে আমাদের প্রতিনিধিদলে এসে যোগ দিয়েছিলেন। তিনিই এ-বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ব্যুরোর কাছে সরকার কৈফিয়ত চায় এবং আমি ফিরে আসার পরে ব্যুরোর বিপন্ন প্রধান। এ বি চৌধুরী আমার শরণাপন্ন হন। আমি লিখিতভাবে এই ভ্রান্তির দায়িত্ব স্বীকার করি, তবে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, মনে হয়, বিষয়টা সেখানেই থামিয়ে দেন।
তবে এক্সপো ২০০০ বেশ উপভোগ্য হয়েছিল আমাদের জন্যে। বেশ স্বাধীনভাবে আসা-যাওয়া, ঘোরা-ফেরা। গোলাম রহমান অতি সজ্জন ব্যক্তি, তার সৌজন্যের শেষ ছিল না। হ্যাঁনোফারের পালা শেষ করে আমরা এলাম। বার্লিনে। সেখানে আমাদের রাষ্ট্রদূতের বাড়িতে অকৃপণ আপ্যায়ন এবং আমার পরিচিতজনদের সঙ্গে দেখাশোনার অপরিমিত সুযোগ। বার্লিন থেকে লন্ডন হয়ে। আমাদের স্বদেশ-প্রত্যাবর্তন।
লন্ডনে সেবারও আমি ছিলাম সিরাজুর রহমানের বাড়িতে। ততদিনে তিনি প্রবলভাবে আওয়ামী লীগ-বিরোধী। তার বাড়িতে আমার থাকা নিয়ে কেউ কেউ বিস্মিত ও সমালোচনামুখর এবং ঢাকায় সরকারের উচ্চমহলে তা জ্ঞাপনের কষ্টস্বীকারে প্রবৃত্ত। এ-নিয়ে আমাকে কেউ কিছু বলেননি বটে, তবে সরকারপ্রধানের নাম করে একটা কটু কথা মুখে মুখে ছড়িয়ে গিয়েছিল।
আমাকে ঘর-সংসার দেখতে হয় না, বলা যায়। সে-দায়িত্ব বেবী নিজের কাঁধেই নিয়েছে। মেয়েরা যার যার মতো সংসার করছে। রুচির দুই সন্তান : অরণি আর অলয়–একজন দশ, একজন নয় বছর বয়সী। শুচির একটাই ছেলে, সবে এক বছর পেরিয়েছে। আনন্দেরও বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়ে গেল। পাত্রী শারমিন রশীদ, ডাক নাম ইলোরা, ডা. রশীদ আহমদের ছোটো মেয়ে। ওঁরা লালমাটিয়ায় থাকেন, চাঁদপুরের শাহরাস্তি গ্রামের আদি বাসিন্দা। আনন্দের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আগস্ট মাসে যেদিন ডা. রশীদের বাড়ি যাওয়া হয়, হুমায়ূন আহমেদের পীড়াপীড়িতে তার আগের দিন সকালে বেবী ও আমি গিয়েছিলাম নুহাশপল্লীতে। হুমায়ূন এবং মাজহার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, যথাসময়ে আমাদের ফিরে আসার ব্যবস্থা করে দেবে। ওরা যথাসাধ্য কথা রাখতে চেষ্টা করেছিল, কিন্তু পথের মধ্যে গাড়ি বিকল হয়ে যায়। আরেক গাড়ি এসে আমাদের উদ্ধার করে আনতে আনতে অত্যধিক দেরি হয়ে গেল। যারা প্রস্তাব নিয়ে যাবেন, পাত্রের বাপ-মার এমন দায়িত্বহীন আচরণে তারা অত্যন্ত বিরক্ত হন। যথাসময়ে তাদের যেতে না পারার দায়টা আমারই। অবশ্য অক্টোবরে বিয়ের কথা পাকাপাকি হলো যখন, তখন দায়িত্বপালনে শৈথিল্য ঘটেনি। ঠিক হলো, বিয়ে হবে ২০০১-এর জানুয়ারিতে।
আরো নিকটজনকে হারালাম এরই মধ্যে। আমার শ্বশুর লোকান্তরিত হলেন ১৯৯৪ সালের ১৫ জুলাইতে। তিনি হাসপাতালে ছিলেন মাত্র কয়েকদিন। তখন শিল্পী সফিউদ্দীন আহমদের চিকিৎসাও চলছিল ওই হাসপাতালে, ওঁর পাশের কেবিনেই। প্রেস ক্লাবে আমার শ্বশুরের জানাজায় অনেক জনসমাগম হয়েছিল। আমার মামাতো বোন হালিমাকে হাসপাতালে দেখে আমি গেলাম কলকাতায়। ফিরে এসে শুনি ১৯৯৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর তার মৃত্যু হয়েছে। কী যেন সে বলতে চেয়েছিল আমাকে তার মৃত্যুর আগে, তা আর জানা হলো না। ১৯৭৫ সালের পরে, বিশেষ করে জীবনের শেষদিকে, দেশ সম্পর্কে তার উদ্বেগ অনেক বেড়ে যায়, কবিতায় তা সে প্রকাশ করার চেষ্টা করে। তার কয়েকটায় সুর দিয়ে গানের একটা সিডিও বেরিয়েছিল। এরপর বড়োবু। এক্ষেত্রেও আমি কলকাতায় ছিলাম। ফিরে এসে বিমানবন্দর থেকে সোজা গেলাম হাসপাতালে। তাকে আর পেলাম না। আমার ভাগ্নে-ভাগ্নিদের ইচ্ছায় লাশের সঙ্গে আমিই এলাম তার বাড়িতে–১৯৯৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি। আমার জীবনের খুব বড়ো একটা বন্ধন কেটে গেল। দীর্ঘ রোগভোগের পর ১৯৯৯ সালের ৬ মে হাসপাতালে জীবনাবসান ঘটল আমার বন্ধু সৈয়দ আহমদ হোসেনের। আমরা একসঙ্গে স্কুলে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিলাম। তার পরবর্তী পঞ্চাশ বছর একটা অচ্ছেদ্যবন্ধনে আমরা জড়িত ছিলাম। তার মৃত্যু আমাদের বন্ধুমহলে সত্যি সত্যি শূন্যতার সৃষ্টি করেছিল।