সংবিধান-প্রণয়ন কমিটির কাছে গণপরিষদের বাইরে থেকে নানা ধরনের পরামর্শ-সংবলিত ৯৮টি স্মারকলিপি এসেছিল। সদস্যদের বিবেচনার জন্যে তা যথারীতি বিলি করা হয়েছিল।
গণপরিষদে সংবিধান-বিল উত্থাপিত হলে সংশোধনীর প্রস্তাব আসে ১৩৪টি, তার মধ্যে আওয়ামী লীগ-দলীয় সাংসদদের ৬০টি এবং সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের একটি সংশোধনী গৃহীত হয়। ৭০ অনুচ্ছেদ শেষ পর্যন্ত সংশোধিত হয়। খসড়ায় যেখানে বলা হয়েছিল যে, দল থেকে পদত্যাগ করলে কিংবা বহিষ্কৃত হলে সেই দলের মনোনয়নলাভকারী সংসদ-সদস্য সংসদে তার সদস্যপদ হারাবেন, সেখানে সংশোধিত অনুচ্ছেদে বলা হলো, দল থেকে পদত্যাগ করলে বা দলের বিপক্ষে ভোট দিলে তিনি সদস্যপদ হারাবেন। এই অনুচ্ছেদক্রমে প্রদত্ত কোনো আদেশ বা গৃহীত ব্যবস্থা সম্পর্কে আদালত প্রশ্ন করবেন না, মূলের এই বিধানও বাদ পড়ল।
একটা বড়োরকম পরিবর্তন এলো ৬ অনুচ্ছেদে। সংবিধান-বিলে এতে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইনের দ্বারা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হইবে। সরকারদলীয় সদস্য আব্দুর রাজ্জাক ভূঁইয়া সংশোধনী এনে এর পরে যোগ করতে চাইলেন : বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাঙালী বলিয়া পরিচিত হইবেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত গণপরিষদ-সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বললেন যে, পার্বত্য এলাকার অধিবাসীরা বাঙালি নয়; বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে তারা নিজেদের বাংলাদেশি বলে বিবেচনা করে, কিন্তু তাদের কখনো বাঙালি বলে অভিহিত করা হয়নি; এই সংশোধনী গ্রহণ করলে চাকমা জাতি ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু সংসদ-সদস্যদেরা এক কথায় সংশোধনীটি সমর্থন করলেন, এটি গৃহীত হলো, মানবেন্দ্র লারমা প্রতিবাদে সংসদ-কক্ষ ত্যাগ করলেন।
পাহাড়ি জনসমষ্টির স্বাতন্ত্রের বিষয়টি সেদিন আমরা বুঝতে পারিনি। মানবেন্দ্র লারমাও সেদিন পাহাড়ি ও চাকমা প্রায় সমার্থক করে ফেলেছিলেন, অন্যান্য নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর উল্লেখ করেননি। ২৪ বছর ধরে বাঙালি জাতিসত্তার জাগরণ ঘটছিল; মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে। পাকিস্তান আমলে পাহাড়িরা কখনো নিজেদের স্বতন্ত্র জাতিসত্তার কথা বলেনি। মুক্তিযুদ্ধে পাহাড়িদের কিছুসংখ্যক অংশগ্রহণ করেছিল–মিজো জাতিসত্তার সংগ্রাম তাদের অনুপ্রাণিত করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাহাড়িদের প্রথাগত নেতৃত্ব ছিল পাকিস্তান সরকারের মিত্র। তখনো রাঙামাটির রাজা ত্রিদিব রায় পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী এবং বাংলাদেশ-বিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত। বাংলাদেশ-বিরোধী অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠী স্বাধীনতার পরে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে আশ্রয় নেয় এবং তাদের বিতাড়ন করতে সেখানে দুবার অভিযান পরিচালিত হয়–একবার ভারতীয় বাহিনীর সাহায্য নিয়ে। এই অবস্থায় ১৯৭২ সালের জুন মাসে মানবেন্দ্র লারমার নেতৃত্বে যে পার্বত্য চট্টগ্রাম সংহতি দল গঠিত হয়, সেটাও অনেকে ভালোভাবে দেখেনি।
পাহাড়িদের নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র যে সেদিন আমরা উপলব্ধি করতে সমর্থ হইনি, এ ছিল নিজেদের বড়োরকম এক ব্যর্থতা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ থেকে প্রেরণা পেয়েও যে পাহাড়ি জাতীয়তাবোধের বা চাকমা জাতীয়তাবোধের সূচনা হতে পারে, এ-কথা একবারও আমাদের মনে হয়নি। নিজেদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সাফল্যে আমরা তখন বেশিদূর দেখতে পারছি না, মুক্তিযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির পরে অন্য কোনো জাতীয়তাবোধ স্বীকার করতে পারছি না, বরঞ্চ তাকে সন্দেহের চোখে দেখছি। ৬ অনুচ্ছেদের ওই ছোট্ট সংশোধনীকে উপলক্ষ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জাতিত্বের সঙ্গে পাহাড়িদের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার যে-বিরোধ সেদিন সূচিত হলো, তার ফল কত সুদূরপ্রসারী হয়েছিল, তা এখন আমরা জানি।
এখানে একটি কথা বলা হয়তো অপ্রাসঙ্গিক হবে না। খসড়া সংবিধান-প্রণয়ন কমিটির রিপোর্টে যারা ভিন্নমতসূচক মন্তব্য যুক্ত করেছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ এবং গণপরিষদে সংবিধান বিল উত্থাপনের পরে যারা সংশোধনী এনেছিলেন, তাঁদের অনেকেই কিন্তু নেয়ামাল বাসির বা আমাকে দিয়ে তাদের বক্তব্য বা সংশোধনীর ভাষা পরিমার্জনা করে নিয়েছিলেন। এতে কামাল হোসেন বা আর কেউ কিছু মনে করেননি। সেই উদারতার বাতাবরণ কখন যেন হারিয়ে গেল। হাফিজ হাবিবুর রহমান যে তখন প্রকাশ্যে দলীয় একনায়কত্বের ও দলীয় নেতার একনায়কত্বের সৃষ্টির আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, সে-কথাটাও মনে রাখার যোগ্য।
সংবিধান বিলের বিভিন্ন অনুচ্ছেদ নিয়ে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বেশ দীর্ঘ ও তীব্র বক্তৃতা দিতেন। বঙ্গবন্ধু একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি সুরঞ্জিতের বক্তব্য শুনছি কি না। গণপরিষদের অধিবেশন চলাকালে আমি প্রায়ই সদস্যদের পেছনে আমলাদের সারিতে বসতাম–কোনো প্রশ্নে আইনমন্ত্রীর সাহায্য প্রয়োজন হলে সেখান থেকেই চিরকুট চালাচালি করতাম। তবে সর্বক্ষণ উপস্থিত থাকতে পারতাম না। গণপরিষদ-ভবনে আমাকে যে-কক্ষটি বরাদ্দ করা হয়েছিল, সেখানে বসে বিতর্ক শোনার ব্যবস্থা ছিল, শুনতামও। বঙ্গবন্ধুর প্রশ্নের উত্তরে বললাম, মাঝে মাঝে শুনি। তিনি হেসে বললেন, ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান। গণপরিষদে কনস্টিটিউশন নিয়ে আমি যেসব কথা বলেছি, সেসব কথাই এখন। সুরঞ্জিত আমাকে শোনাচ্ছে। তখনকার হাউজের ডিবেট পড়ে দেখো।