কিছুদিন ধরেই সরকারদলীয় ব্যক্তিরা মোহাম্মদ আবু হেনার সমালোচনায় নানা কথা বলছিলেন। আবু হেনাও ছুটি নিয়ে অনেকদিন বিদেশে থেকে এলেন। আমার ধারণা হয়েছিল, সরকারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিল। না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুকাল আমরা একসঙ্গেই শিক্ষকতা করেছি। আমি তাঁকে জানি একজন সজ্জন ও বিবেচক মানুষ হিসেবে। ১৯৯৬ সালে নির্বাচন পরিচালনায় তিনি দক্ষতার পরিচয় দেন এবং বিরোধী দলের অন্যায় সমালোচনার মুখে পড়েন। তাতে অবশ্য তিনি অবিচলিত ছিলেন। এখন তাঁর ‘অসুস্থতাজনিত’ পদত্যাগের ঘটনা এমনভাবে ঘটলো যে, এটা আর পুনর্বিবেচনার সুযোগ রইল না।
শেখ হাসিনাকে আমি বললাম, ‘তুমি বিরোধী দলের নেত্রীকে আমন্ত্রণ জানাও পরবর্তী প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের প্রশ্নে আলাপ করতে।’
হাসিনা বললো, ‘উনি আসবেন না।’
আমি বললাম, সেক্ষেত্রে তুমি বলতে পারবে, এ-বিষয়ে একমত হওয়ার চেষ্টা তুমি করেছিলে। যদি উনি আসেন এবং তোমরা একমত হতে পারো, তাহলে সকলেই স্বস্তি পাবে। যদি উনি না আসেন কিংবা একমত না হন, তখন নিয়োগের ব্যাপারটা তোমার হাতেই রয়ে যাবে।’
সামান্য একটু ভেবে নিয়ে হাসিনা কথাটা মানলো। তার দপ্তরের একজন কর্মকর্তাকে ডেকে বললো, নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের বিষয়ে পরামর্শের জন্যে বিরোধী দলের নেত্রীকে একটা সময় দিয়ে আমন্ত্রণ পাঠিয়ে দিন।
শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রীত্বকালে আমি এই একবারই তাকে অযাচিত পরামর্শ দিয়েছিলাম এবং সেটা সে গ্রহণ করেছিল। পরে আরেকবার তাকে কিছু বলেছিলাম, কিন্তু কথাটা তার মনঃপূত হয়নি।
বিরোধী দলের নেত্রী অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণ গ্রহণ করেননি। প্রধানমন্ত্রী তখন নিজের অভিপ্রায়-অনুযায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দিয়েছিলেন।
৫২.
২০০০ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলা চলার সময়ে হুমায়ূন আহমেদ জানালো, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান সংকট নিয়ে সে পরিবারের লোকজনসমেত সেখানে একদিনের প্রতীকী অনশন ধর্মঘট করতে যাচ্ছে।
শাহ্জালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ শিক্ষক মুহম্মদ জাফর ইকবালের নেতৃত্বে জাহানারা ইমামের নামে সদ্যনির্মিত একটি আবাসিক হলের নামকরণের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। এ-নিয়ে তারা উগ্রপন্থীদের আক্রমণের শিকার হন এবং তার প্রতিবাদে তারা অবিরাম ধর্মঘট করতে শুরু করেন। আক্রান্ত শিক্ষকদের দাবির সমর্থনে হুমায়ূন অনশনের চিন্তা করে।
হুমায়ূনের কথা শুনে আমি তৎক্ষণাৎ বললাম, ‘যদি পরিবারের বাইরের লোকজন সঙ্গে নাও, তাহলে আমিও তোমার সঙ্গে যেতে পারি।’
হুমায়ূন বললো, ‘আপনি গেলে খুব খুশি হবো। আপনাকে আমি পরিবারের বাইরে ভাবি না।’
২৫ মার্চ রাতের ট্রেনে আমরা সিলেটে রওনা হলাম। হুমায়ূনের দলে অনেক মানুষ, বেশিরভাগ ওর পরিবারের বাইরে। অন্যদিরে সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম আছে সদলবলে, অনেক তরুণ-তরুণীও যোগ দিয়েছে। ট্রেনের কয়েকটা কামরা রিজার্ভ করা হয়েছে, কমলাপুর স্টেশনে নিরাপত্তার বিশাল ব্যবস্থা।
সিলেটে পৌঁছে দেখা গেল, সেখানেও নিরাপত্তার আয়োজন খুব বিশাল। বাংলা একাডেমির ওবায়দুল ইসলাম–আমার ছাত্র-আমাকে নিয়ে গেল তার শ্বশুরবাড়িতে মুখহাত ধুয়ে নাশতা খাওয়ার জন্যে। হোটেলে অবশ্য থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল, তবে ওবায়েদের কথামতো আগে ওর সঙ্গে গেলাম, পরে এলাম হোটেলে।
হুমায়ূন শাহজালালের মাজার জিয়ারত করে তার কর্মসূচির সূচনা করলো। আমরা অনেকে সরাসরি শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে গেলাম। সেখানে এবং সারা পথেই পুলিশ প্রহরা। অনশনকারীরা একরকম পুলিশ প্রহরায়।
হুমায়ূনের সঙ্গে ওর ভাইবোনেরা আছে, ওর মাও। মাজহারের সঙ্গে একদল। হায়াৎ মামুদ ও প্রকাশক আলমগীর রহমান একসঙ্গে। ওবায়েদের সঙ্গে আমি।
আমরা বসে থাকতে থাকতে উপাচার্য অধ্যাপক হাবিবুর রহমান এলেন। তিনি ভালোমানুষ, কেউ কেউ অবশ্য তাকে ভুল বুঝছে।
বেতার-টেলিভিশন-সংবাদপত্রের সংবাদদাতাদেরও বিরাট বাহিনী। পুলিশের পাহারা সত্ত্বেও কৌতূহলী মানুষেরও ভিড় কম নয়। কেউ কেউ নজর রাখছেন অনশনকারীরা লুকিয়ে কিছু খেয়ে ফেলছে কি না তা দেখতে। সামনের একটা বাড়িতে অনেকে যাচ্ছিল টয়লেট ব্যবহার করতে। সেটা খানিকটা সন্দেহের উদ্রেক করে।
হুমায়ূন একটা আনুষ্ঠানিক বিবৃতি পাঠ করেছিল। তাতে জানানো হয়েছিল, ‘শাহজাল বিশ্ববিদ্যালয়কে রক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষকদের ওপর হামলার প্রতিবাদ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখার জন্য’ এই অনশন।
অনশনের সময় শেষ হলে সবাই হুড়মুড় করে হোটেলে ফিরে গেল। আমি একা পড়ে থাকলাম। পুলিশের এক কর্মকর্তা আমাকে লক্ষ করে ফেরার ব্যবস্থা করে দিলেন।
সেই রাতেই আমরা ট্রেনে ঢাকার পথে রওনা হলাম।
তার কয়েকদিন পর শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ঢাকায় আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসে এলেন। তিনি সনির্বন্ধ অনুরোধ জানালেন, হুমায়ূনকে বুঝিয়ে আন্দোলনের ইতি টানার। নইলে, তার আশঙ্কা, বড়ো ধরনের গোলযোগ হবে এবং তা সামলানো তাঁর পক্ষে অসাধ্য হবে, বিশ্ববিদ্যালয়ও বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়বে।
আমি হুমায়ূনকে কথাগুলো জানালাম। হুমায়ূন এই সংকট নিয়ে আর কোনো কর্মসূচি হাতে নেয়নি।
৫২.
২০০০ সালে আমার তিনটি বই প্রকাশিত হয় : অন্যপ্রকাশ থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ, শিখা প্রকাশনী থেকে পূর্বগামী এবং সাহিত্য প্রকাশ থেকে বাঙালি নারী : সাহিত্যে ও সমাজে। এর আগের বছর অন্যপ্রকাশ থেকে বের হয় আমার চোখে এবং আগামী প্রকাশনী থেকে মুক্তিযুদ্ধ এবং তারপর। আমার লেখা বই বছরে একটা প্রকাশ পায় কি না সন্দেহ (১৯৯৭তে সাহিত্য প্রকাশ থেকে বেরিয়েছিল আমার একাত্তর, ১৯৯৮তে কোনো বই বের হয়নি)। সেখানে পর পর দু বছরে একাধিক বই বেরোনো আমার জন্যে ঘটনা বই কি!