অ্যানজিওগ্রাম হয়ে গেল। এবারে একটা ট্রলিতেই আমাকে শুইয়ে রাখা হলো বারান্দায়। বহুক্ষণ পরে দুই শয্যাবিশিষ্ট কেবিনের একটিতে আমাকে আশ্রয় দেওয়া হলো–বোধহয় ঘণ্টাখানেকের জন্যে। রিপোর্ট যা পাওয়া গেল, তার মর্ম এই যে, আমার ধমনীতে ব্লক আছে, তবে এখনই কিছু করার দরকার নেই।
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আবার আতিকুর রহমানের বাড়ি।
আতিকুর রহমানের দিল্লির বাড়িতে আমি একাধিকবার থেকেছি। তারা স্বামী-স্ত্রী সজ্জন মানুষ, খুবই অতিথিপরায়ণ। আমাকে যথেষ্ট যত্নে রেখেছিলেন। ১৯৭১এ আতিক কাজ করতেন দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায়। আমার ছাত্র চৌধুরী মঈনুদ্দীন ছিল তাঁর কনিষ্ঠ সহকর্মী। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে মঈনুদ্দীন আতিকের ঠিকানা চেয়েছিল। এটা স্বাভাবিক মনে না হওয়ায় আতিক তাকে অন্য একটা ঠিকানা দিয়েছিলেন। কয়েকদিন পরে সেই ভুল ঠিকানায় আল বদর বাহিনী হানা দিয়েছিল আতিকের খোঁজে। আমার ছাত্র মঈনুদ্দীন, পরে জানা যায়, তখন ছিল ওই বাহিনীর অপারেশন ইনচার্জ। তার এবং আমার শিক্ষক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীকে সে-ই ধরে নিয়ে যায়, তিনি আর কখনো ফিরে আসেননি।
এবার মুলেদের কথা বলি।
আমার অনুজপ্রতিম বন্ধু তপন বোস ভাগ্যবান মানুষ। একাদিক্রমে তিনবার বিয়ে করেছে। তার প্রথম স্ত্রীর গর্ভজাত কন্যার বিয়েতে যোগ দিতে দিল্লি গিয়েছিলাম। তপন চিত্রনির্মাতাও। বিয়েতে অতিথিদের মধ্যে দুই বিখ্যাত তারকা নাসিরউদ্দীন শাহ্ ও সুহাসিনী মুলেকে দেখে তাই অবাক হইনি। খানিক পরে জানতে পারি, সুহাসিনী ছিল তপনের দ্বিতীয় স্ত্রী, বিয়েবাড়িতে তার মাও উপস্থিত ছিলেন। বনফুলের কাহিনি-অবলম্বনে মৃণাল সেনের বিখ্যাত ছবি ভুবন সোমে সুহাসিনীর অভিনয় আমাকে মুগ্ধ করেছিল। নাসিরউদ্দীন শাহ ও মিসেস মুলের সঙ্গে আলাপ করলাম বটে, তবে বেশি সময় দিলাম সুহাসিনীকে–তাতে কোনো বাধাও অনুভব করলাম না। মিসেস মুলেও আমাকে বেশ সহৃদয়তার সঙ্গে গ্রহণ করলেন।
সুহাসিনীর সঙ্গে আমার ভাব এমনই জমে গেল যে, পরেরবার দিল্লিতে দেখা হলে আমরা আপনি থেকে তুমিতে নেমে এলাম। সে খুব গল্প করতো সত্যজিৎ রায়ের সহকারী হিসেবে তার কাজ করার অভিজ্ঞতা নিয়ে। সে বলতো, রোজ সকালে কলকাতায় স্টুডিও যাওয়ার পথে একটা মিষ্টির দোকান পার হতে হতো তাকে–সেখানে ওই সকালেই সদ্য তৈরি সন্দেশ সে খুব উপভোগ করতো–এমন দিন ছিল না যেদিন সে তা খায়নি। আমাকে বললো, ‘ঢাকা থেকে আবার যখন আসবে, আমার জন্যে কাঁচা সন্দেশ নিয়ে এসো।’
আমি যেবার তার কথা রাখতে পারলাম, সেবার সে বুম্বাই গিয়েছিল। সন্দেশ অন্য কাউকে দিয়ে এসেছিলাম। তারপর বেশ কিছুদিন বাদে আবার দিল্লি গেছি–সুহাসিনীর হাতে এবার সন্দেশ দিতে পারলাম। তবে বেশ বুঝতে পারলাম, ততদিনে সে আমাকে ভুলে গেছে।
৫১.
১৯৯৯ সালের জানুয়ারিতে কলকাতা বইমেলা উদবোধন করলো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার সঙ্গে গেল বিরাট এক দল–লেখক, সাংস্কৃতিক কর্মী, সাংবাদিক, আমলা। কলকাতায় আমাদের ডেপুটি হাই কমিশনার তখন জালাল আহমেদ। ষাটের দশকের শেষদিকে তিনি যখন টোকিওতে দৈনিক ইত্তেফারে প্রতিনিধি, তখন থেকে তাঁকে চিনি। তার স্ত্রী আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ছাত্রী ছিল। প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতি তাদের দুজনকে এতই অভিভূত করেছিল যে, অন্য কোনোদিকে নজর দেওয়ার অবস্থা তাদের কারো ছিল না। ফলে, প্রধানমন্ত্রীর সহচর ছাড়া, বাকিদের থাকা-খাওয়া চলা-ফেরায় বেশ অসুবিধে হয়েছিল। সাংবাদিকেরা এই অব্যবস্থায় যথেষ্ট ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন এবং এ-সম্পর্কে কাগজে লিখতে দ্বিধা করেননি।
সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা আমাকে অনুরোধ করেছিলেন বইমেলায় উপস্থাপনের জন্যে মূল প্রবন্ধ লিখতে। বই এবং বইমেলা সম্পর্কে প্রবন্ধ একটা সঙ্গে নিয়েছিলাম, কিন্তু উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সেটা উপস্থাপনের কোনো সুযোগই হয়নি। উদ্ববাধনী অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা উদ্ববাধক, মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। সভাপতি, আরো কয়েকজন অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি অংশগ্রহণকারী। তার কর্মসূচিতে কোনো প্রবন্ধ-উপস্থাপনের সুযোগ ছিল না। আমি বিষয়টা মেনেও নিলাম, কিন্তু আমাদের কয়েকজন বন্ধু এ-নিয়ে ভয়ানক আপত্তি তুললেন। ফলে একটা অধিবেশনের ব্যবস্থা হলো এবং আমি প্রবন্ধ পড়লাম।
এর চেয়ে বেশি বিপত্তি ঘটল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের ঘোষণা নিয়ে। সঞ্চালক শেখ হাসিনার পরিচয় দিলেন বাংলাদেশের মুখ্যমন্ত্রী বলে। আমাদের সকলেই বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ। এ-নিয়ে দেশে বিরোধী দল বেশ কথা বলার সুযোগ পেয়ে গেল। তাদের নেত্রী বললেন, ‘উনি ভারতে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে, ফিরলেন মুখ্যমন্ত্রী হয়ে।’ পরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ-নিয়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ করেছিল, ভারত সরকারও নাকি দুঃখ প্রকাশ করেছিল।
মেলার শেষে শেখ হাসিনা হেলিকপ্টারে করে গিয়েছিল চুরুলিয়া ও শান্তিনিকেতনে। নজরুলের উদ্দেশে সম্মান জানিয়ে এসেছিল রবীন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধা জানাতে। বিশ্বভারতী তাকে ‘দেশিকোত্তম’ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করে।
শেখ হাসিনার প্রসঙ্গে আরেকটি কথা দিয়ে শেষ করি। সেই বইমেলার কয়েক মাস পরে জাতীয় জাদুঘরে তার সঙ্গে আবার দেখা হয়েছিল এক অনুষ্ঠানে। তারই সৌজন্যে তার পাশেই বসেছিলাম। একটা বিরতির সময়ে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের কোনো কর্তাব্যক্তি তার কাছে এসে সংগোপনে কিছু বলে গেলেন। তিনি চলে গেলে হাসিনা আমাকে বললো, প্রধান নির্বাচন কমিশনার পদত্যাগ করেছেন, আমি জানার আগেই সাংবাদিকদের তা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার কণ্ঠে ক্ষোভ ঝরে পড়ছে।