ইন্দুর সঙ্গে আমার সম্পর্কের সূচনা হয়েছিল খুব ভালো। আমাদের প্রথম সম্পাদকীয় সভারও আগে আমি দিল্লিতে গিয়েছিলাম একবার–বোধহয় খুশী কবিরের উদযোগে সহমতের সভায় খুশী আর চিত্রনির্মাতা শামীম আখতারের সঙ্গে–ছিলাম ইন্ডিয়া হ্যাঁবিটাট সেন্টারে। খবর জেনে ইন্দু এসে সেখানেই আমাকে লাঞ্চ খাওয়ালো এবং হোটেল থেকে আমি আমাদের হাই কমিশনের প্রেস কাউনসিলর আতিকুর রহমানের বাড়িতে স্থানান্তরিত হবো জেনে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে তার গাড়িতে সেখানে সে আমাকে পৌঁছে দিল। তার গাড়িতে আমি কোট ফেলে যাওয়ায় সে-বাড়িতে সে দ্বিতীয়বারও এলো কোনোরকম বিরক্তি প্রকাশ না করে। তারপর তো কয়েকটি সম্পাদকীয় বৈঠকে দেখাসাক্ষাৎ। ইন্দু এবারে ঢাকায় এলো এবং আমাকে অনুরোধ করলো এখানে তার থাকার ব্যবস্থা করে দিতে। ব্যবস্থা করলাম শেরাটনে, ডিসকাউন্টও পাওয়া গেল। ঢাকায় ইন্দুকে কে যেন বললো, ওই পয়সায় সে সোনারগাঁও হোটেলেই থাকতে পারতো। তাতে আমার প্রতি সে একটু বিমুখ হলো। তার কোনো পরিচিত ভদ্রলোক তাকে মধ্যাহ্নভোজে আপ্যায়িত করবেন কস্তুরীতে। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিয়ে কস্তুরীতে হাজির। দেখি, কেউ নেই। খানিক পরে ফোন করে জানলাম, ওরা আমার জন্যে অপেক্ষা করছে নিমন্ত্রণকর্তার মতিঝিল অফিসে, সেখানেই নাকি সবার মিলিত হওয়ার কথা ছিল। আমার তো সেকথা কিছুতেই মনে পড়ল না। আমি যতই বলি, দেখো, আমার তো ইউনিভার্সিটি থেকে আসার কথা–আমি কেন পুরানা পল্টন ছেড়ে মতিঝিলে গিয়ে সবার সঙ্গে আবার কস্তুরীতে আসতে চাইব, তাতে কোনো কাজ হলো না। ইন্দু ভাবল, আমি যথেষ্ট গুরুত্ব দিইনি তাকে। পরে দিল্লিতে একদিন সে বলছিল, অটলবিহারী বাজপেয়ী ছিলেন জওহরলাল নেহরুর মন্ত্রিসভার সদস্য। আমি বললাম, কথাটা ঠিক নয়। এ নিয়ে তর্ক, তার মুখ ভার। তারপর একদিন সে আমার সংগৃহীত একটি লেখা হারিয়ে ফেললো–আমি তাকে বললাম, ভদ্রলোকের কাছে আরেকবার লেখা চাইতে আমার খুব খারাপ লাগবে, তিনিই বা কী ভাববেন! তাতে সে মন খারাপ করলো। ওদিকে ব্রিটানিকা জুনিয়র এনসাইক্লোপিডিয়ায় আমার লেখা ছাপা হয়ে গেছে, সে আমাকে একসেট বই দিতে গড়িমসি করছে, তাতে আমি তার প্রতি বিরক্ত। এই অবস্থায় আমাকে না জানিয়ে বাংলাদেশ থেকে সে একজনের লেখা চাওয়ায় আমি ঠিক করলাম, আর এই প্রকল্পের সঙ্গে আমি যুক্ত থাকব না। সে অবশ্য বললো, সে আমাকে ই-মেইল করে ব্যাপারটা জানিয়েছিল, আমার উত্তর না পেয়ে ধরে নিয়েছে, আমার সম্মতি আছে।
মাঝে আমি র্যালফকে একবার বলেছিলাম, ইন্দুর সঙ্গে কাজ করতে আমি স্বচ্ছন্দ বোধ করছি না। র্যালফ ভালোমানুষ, সে বলে, ইন্দু অনেক চাপের মধ্যে কাজ করে, তাই সবসময়ে ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে না–তুমি নিজগুণে ক্ষমা করে দিও। এবারে র্যালফকে কিছু না বলে আমি সরাসরি পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিলাম শিকাগোতে, ব্রিটানিকার সদর দপ্তরে মনে হয় ২০০০ সালে। লিখলাম, আমার মনে হয়, ইন্দু আর আমি পরস্পরকে ঠিকমতো বুঝতে পারিনে। আবাসিক সম্পাদক হিসেবে তাকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে–সুতরাং সম্পাদকমণ্ডলী থেকে আমার নামটা প্রত্যাহার করে নিচ্ছি।
সত্যেশদা আমায় বললেন, তুমি পদত্যাগ করে ঠিক করোনি, পদত্যাগের ভয় দেখালেই পারতে। পরে রমিলা আমাকে জানিয়েছিল, ইন্দুর আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে সে-ও ওই প্রকল্পের সঙ্গে তার সম্পর্ক রাখেনি। আরো পরে জানলাম, প্রকল্পটা বাতিল করা হয়েছে। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার সঙ্গে সম্পর্কস্থাপনের দ্বিতীয় সুযোগটাও এভাবে নষ্ট হলো।
৫০.
যেবার সহমতের সম্মেলনে গিয়েছিলাম, সেবারই নিজের হৃদয়ঘটিত সমস্যার কারণে দিল্লির এসকর্ট হাসপাতালের দ্বারস্থ হলাম। এমনই দুর্ভাগ্য যে, হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগের দিনই ডলারের ওয়ালেটটা হারিয়ে ফেললাম। খবর শুনে মিসেস মুলে আমার চিকিৎসার ব্যয়নির্বাহের জন্যে প্রায় চাঁদা তোলারই আয়োজন করেছিলেন, অতি কষ্টে তাঁকে নিবৃত্ত করা গেল এই কথা বলে যে, আমার ভায়রা হাসান এই মুহূর্তে এসকর্টেই আছে। সে বের হলে আমি ঢুকব। আমার চিকিৎসার খরচ আপাতত তার কাছ থেকেই নেওয়া যাবে। মিসেস মুলের আরেক পরিচয়, তিনি খ্যাতনামা অভিনেতা সুহাসিনী মুলের মা। তাঁদের সঙ্গে আমার আলাপ হয় তার আগের বছর–সেকথা পরে বলছি।
প্রাথমিক পরীক্ষার পর সাব্যস্ত হয় যে, আমার অ্যানজিওগ্রাম করতে হবে। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার জন্যে প্রয়োজনীয় টাকাপয়সা জমা দেওয়ার পরই ক্যাশিয়ার মেয়েটি জানালো, এখানে জায়গা নেই, কাল সকাল বেলায় হাসপাতালে আমি হাজির হলে চলবে। আমার ভায়রা হাসান বললো, তাহলে তোমরা হাসপাতালে থাকার যে খরচটা নিয়েছ, সেটা ফেরত দাও, সেই পয়সা দিয়ে উনি কোনো হোটেলে থাকবেন। মেয়েটি বললো, পয়সা ফেরত দেওয়ার নিয়ম নেই, তোমাদের ব্যবস্থা তোমাদেরই করতে হবে। অগত্যা আতিকুর রহমানের বাড়ির দরজায় কড়া নাড়া।
খুব সকালে হাসপাতালে এসে ওয়েটিং রুমের মতো একটি জায়গায় অনেকক্ষণ বসে থাকা। তারপর কাপড় বদলিয়ে ট্রলিতে করে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া, বিছানায় শোয়ানো। তখনই কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম : কী সার, আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে এসেছেন!’ আরে, এ তো ঢাকায় আমার কার্ডিওলজিস্ট ডা. সোহরাবউজ্জামানের গলা। বললাম, এক মাস ধরে আপনাকে খুঁজে পেলাম না, আর আপনি এখানে!’ তিনি জানালেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফেলোশিপ নিয়ে তিনি এখানে এসেছেন কিছুকালের জন্যে, আমার অ্যানজিওগ্রাম করার দায়িত্ব তারই। ভালোই হলো।