নজরুল-জন্মশতবর্ষের অনুষ্ঠানমালা শুরু হয় ১৯৯৮ সালের ২৫ মে (১৪০৫ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ) সকালে, মিরপুর ইনডোর স্টেডিয়ামে। মূল অনুষ্ঠান ছিল তিন দিনের। ঢাকার সঙ্গে সঙ্গে ত্রিশাল, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামেও তিন দিনের অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। ঢাকায় যখন অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কথা, আমাদের ভাগ্যদোষে তার একটু আগেই বিদ্যুৎ-সরবরাহে বিঘ্ন ঘটল। প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি–তার নিরাপত্তার দায়িত্বে নিযুক্ত কর্মকর্তারা। অনুষ্ঠানস্থলে বিদ্যুৎ-সরবরাহ স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত তাকে ঘর থেকে রওনা হতে দিলেন না। বিদ্যুৎ এলো, শেখ হাসিনা এলো আরো পরে। শিল্পীরা এবং অতিথিরা ঘর্মাক্তকলেবর হয়ে অতিষ্ঠ। তবে অনুষ্ঠান ভালো হয়েছিল। সুফিয়া কামাল আসতে পারেননি, তাঁর লিখিত সভাপতির ভাষণ অন্য কেউ পড়ে দিয়েছিল। সংস্কৃতি-সচিব ড. শামসুজ্জামান মজুমদার স্বাগত ভাষণ দেন লিখিত আকারে, রফিকুল ইসলামের নজরুল-জন্মশতবর্ষ বক্তৃতাও ছিল লিখিত। প্রধান অতিথির উদৃবোধনী ভাষণ এবং ওবায়দুল কাদের, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ও আমার সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা ছিল মৌখিক। নৃত্যগীতবাদ্যআবৃত্তি মানসম্মত হয়েছিল। বেতারে-টেলিভিশনে-সংবাদপত্রে প্রচারও হয়েছিল ভালো।
পরের বছরে, যথার্থ শতবর্ষে, অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়েছিল ১৭ বৈশাখ থেকে ১১ জ্যৈষ্ঠ পর্যন্ত। কী হিসাবে, তা আর এখন মনে নেই। প্রথম দিনে জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে সম্মেলনমালা’ উদ্বোধন করেন প্রধান অতিথি বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান। পদাধিকারবলে বক্তাদের মধ্যে কিছু যোগবিয়োগ ঘটেছিল। আমার নতুন পদবি জুটেছিল নজরুল-সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আহ্বায়ক বলে। প্রধান অতিথির আগে আমরা জনাদশেক বক্তৃতা দিয়েছিলাম, তার পরে সভাপতির ভাষণ দিয়েছিল ওবায়দুল কাদের। অনুষ্ঠান ভালো হলেও এবারে প্রচার ভালো হয়নি। সেদিন ক্রিকেট খেলায় বাংলাদেশ হারিয়ে দিয়েছিল জিম্বাবুয়েকে। সব প্রচারমাধ্যমে সে-খবরই প্রাধান্য পেয়েছিল। তবে ১১ জ্যৈষ্ঠে ওসমানী মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় মূল অনুষ্ঠান। তাতে প্রধান অতিথি ছিলেন শেখ হাসিনা। সে-অনুষ্ঠানের প্রচার মন্দ হয়নি। আন্তর্জাতিক সম্মেলন তেমন আন্তর্জাতিক না হওয়ায় তাকে বলা হয়েছিল প্রস্তুতি পর্ব। এর একটি অধিবেশন হয় জাদুঘরের সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে, বাকি তিনটি নজরুল ইন্সটিটিউট মিলনায়তনে। অধিবেশনগুলোতে সভাপতিত্ব করেন যথাক্রমে খান সারওয়ার মুরশিদ, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আবু রুশদ ও কবীর চৌধুরী।
জন্মশতবর্ষ উদ্যাপনের সমাপ্তি ঘটে ২০০০ সালে ২৫ থেকে ২৭ মে তিনদিনব্যাপী অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। প্রায় প্রথমবারের পুনরাবৃত্তি। তবে লোকজনের উৎসাহ ছিল প্রচুর। শিল্পীরা পূর্বাপর মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে পেরেছিলেন। ঢাকার বাইরে সেবারও অনেক অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। ততদিনে নজরুল ইন্সটিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতির দায়িত্বপালন আমার শেষ হয়েছে।
৪৯.
শিকাগো থেকে বন্ধু রালফ নিকোলাসের চিঠি। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা স্বতন্ত্রভাবে একটি এশীয় সংস্করণ প্রকাশ করতে যাচ্ছে। তার সম্পাদকমণ্ডলীতে থাকতে আমার সম্মতি আছে কি না জানতে চায়। ১৯৭০ সালে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকায় লেখার সুযোগ পেয়েও পরিস্থিতির কারণে তা হারানোর দুঃখ আমার মনে ছিল। কালবিলম্ব না করে র্যালফকে জানালাম, আমি রাজি। তার পরপরই আনুষ্ঠানিক চিঠি এলো শিকাগোতে ওই বিশ্বকোষের সদর দপ্তর থেকে। সেটা ১৯৯৮ সালের কথা।
সম্পাদকমণ্ডলী গঠিত হয়েছিল ভারত থেকে বিশিষ্ট পণ্ডিত কপিলা বাৎস্যায়ন, ইতিহাসবিদ রমিলা থাপার, ভূগোলবিদ সত্যেশ চক্রবর্তী ও এক বিজ্ঞানী, পাকিস্তান থেকে প্রত্নতাত্ত্বিক রফিক মুঘল, শ্রীলঙ্কা থেকে পেরোনিয়া ইউনিভার্সিটির ভাইস-চান্সেলর ইতিহাসবিদ লেসলি গুণারত্নে, বাংলাদেশ থেকে আমাকে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে রালফ নিকোলাস এবং আরো একজন সমাজবিজ্ঞানী নিয়ে। দিল্লিতেই সম্পাদকমণ্ডলীর বৈঠক হতো। সে-সময়ে ব্রিটানিকার সদর দপ্তর থেকে একজন সম্পাদক নিয়মিত যোগদান করতেন। আবাসিক সম্পাদক ছিল ইন্দু রামচন্দ্রানী। সে যে কোনো বিশেষ ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞ, তা নয়, তবে প্রকাশনা-সংস্থায় সম্পাদক হিসেবে তাঁর দীর্ঘকালের অভিজ্ঞতা আছে।
ব্রিটানিকার ব্যবস্থাপনা ছিল খুব উল্লেখযোগ্য। বিমানে আমাদের যাতায়াতের ব্যবস্থা ছিল বিজনেস ক্লাসে। দিল্লিতে থাকা ইন্ডিয়ান হ্যাঁবিটাট সেন্টারে। স্থানীয়ভাবে চলাফেরা দিল্লি অফিসের সৌজন্যে ভাড়া-করা সার্বক্ষণিক গাড়িতে। সম্পাদকীয় বৈঠক হতো দু দিন ধরে।
বাংলাদেশের নানান দিক নিয়ে লেখা সংগ্রহ ও সম্পাদনার দায়িত্ব ছিল আমার। অনেকের লেখা পেয়েছিলাম। সংগৃহীত রচনার লেখক-তালিকাকে র্যালফ তুলনা করেছিল ‘হুজহু’র সঙ্গে। দুটো লেখার ভার ছিল আমার ওপরে। তার একটি বাংলা ভাষা সম্পর্কে। সেটি জমা দেওয়ার পরে ব্রিটানিকা জুনিয়র এনসাইক্লোপিডিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। অপর লেখাটি বাংলাদেশের সাহিত্য-বিষয়ে–সেটা শেষ পর্যন্ত লেখা হয়নি।
কিছুকাল পরে একটা সমস্যা দেখা দিলো। লেসলি হয়ে গেল শ্রীলঙ্কার শিক্ষামন্ত্রী, ফলে তার পক্ষে আর সম্পাদকমণ্ডলীর সভায় যোগ দেওয়া সম্ভবপর হলো না। ওদিকে ভারতীয় ভিসা পেতে প্রায়ই রফিক মুঘলের অসুবিধে হচ্ছিল। তিনিও আর আমাদের বৈঠকে নিয়মিত আসতে পারছিলেন না। ইন্দু রামচন্দ্রানীর কাজেকর্মে অসন্তুষ্ট হয়ে সত্যেশ চক্রবর্তী একদিন পদত্যাগের হুমকি দিলেন, অবশ্য তাঁকে নিরস্ত করতে বেশি বেগ পেতে হয়নি।