১৯৯৪ সালের মে মাসে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন ইন্তেকাল করেন। নজরুল ইন্সটিটিউটে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন ওবায়েদ-উল-হক। ওদিকে মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ্র কার্যকাল শেষ হলে মুহম্মদ নুরুল হুদা সে-জায়গায় এলো ১৯৯৬ সালে। সে প্রচণ্ড উৎসাহ নিয়ে কাজ করতে শুরু করলো এবং খুব জোর দিলো প্রকাশনার বিষয়ে। পর বছর সভাপতির কার্যকালও শেষ হয়ে যায়। ওবায়েদ-উল-হকের শরীরও খুব ভালো যাচ্ছিল না, তাঁর পক্ষে সভায় যোগদান করাও একটু কষ্টকর হয়ে পড়েছিল। এই অবস্থায় তার দায়িত্ব নেওয়ার জন্য সংস্কৃতি-সচিব সৈয়দ ইউসুফ হোসেন আমার কাছে প্রস্তাব করে। আমি তেমন আগ্রহ প্রকাশ না করায় সংস্কৃতি-প্রতিমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের টেলিফোনে আমার কাছে একই অনুরোধ জ্ঞাপন করে। সে বলে, পর বছর থেকে নজরুল জন্মশতবর্ষ উদ্যাপনের সূচনা হবে এবং তার খুবই ইচ্ছা যে, এই উদ্যাগে আমি নেতৃত্ব দিই। নিজের সামর্থ্যের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন থেকেও শেষ পর্যন্ত আমি সে-অনুরোধ রক্ষা করি। দায়িত্ব নেওয়ার কিছুকাল পরে এমন একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যে, আমি পদত্যাগ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আবারো ওবায়দুল কাঁদেরের আন্তরিক ইচ্ছাকে সম্মান জানিয়ে পদত্যাগপত্র পাঠানো থেকে বিরত হই।
যথাসময়ে নজরুল-জন্মশতবর্ষ উদ্যাপনের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রধান পৃষ্ঠপোষক করে জাতীয় কমিটি গঠিত হলো। পৃষ্ঠপোষকদের তালিকায় জাতীয় সংসদের স্পিকার, সাত-আটজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, বিরোধী দলের উপনেতা (ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী), চার মহানগরের মেয়রসহ
আরো আঠারোজন যুক্ত হলেন। বেগম সুফিয়া কামাল সভাপতি, ওবায়দুল কাদের। নির্বাহী সভাপতি। শেখ হাসিনার তিন শিক্ষক–রফিকুল ইসলাম, আমি ও মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান সহ-সভাপতি। ২০১ জনকে নিয়ে কমিটি করার কথা ভাবা হয়েছিল, শেষ পর্যন্ত তা ২০৫ জনে গিয়ে দাঁড়ালো। কমিটি বড়ো হয়ে যাওয়ায়। একটি স্টিয়ারিং কমিটি বা কর্মপরিচালনা-পরিষদ গঠনের আবশ্যকতা দেখা দিলো। জাতীয় কমিটির নির্বাহী সভাপতিই তার সভাপতি, তিন সহ-সভাপতি বিরাজমান, শিল্পী-সাহিত্যিক-অধ্যাপক এবং সরকারি-আধাসরকারি-বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মিলে মোট ৩৩ জন। জাতীয় কমিটির সদস্য-সচিব মুহম্মদ নুরুল হুদা এখানেও সদস্য-সচিব। তার আগ্রহে সবার অতিরিক্ত দুজন প্রতিবেদক এতে যুক্ত হলেন। জাতীয় কমিটির সভায় লোকজন বেশি হয় না; অসুস্থ সভাপতি তেমন আসতে পারেন না, কর্মব্যস্ত নির্বাহী সভাপতিও সাধারণত সময় দিতে পারেন না। সভাপতির আসন গ্রহণ করে রফিকুল ইসলাম দোর্দণ্ডপ্রতাপে সভা চালিয়ে যান। তিনি যা বলেন, নুরুল হুদা তাতে সায় দেন। মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বেশি কিছু বলেন না, আমি প্রায় নীরবেই থাকি। তাতে শবনম মুশতারী কোনো এক পত্রিকায় লিখেছিল, জাতীয় কমিটিতে আমার ভূমিকা মৃত সৈনিকের। আমি যে তাতে অসন্তুষ্ট হয়েছিলাম, তা নয়।
কবির জন্মশতবর্ষ-উপলক্ষে নজরুল ইন্সটিটিউট থেকে অন্তত শখানেক বই প্রকাশের পরিকল্পনা করেছিল নুরুল হুদা। যেসব বিষয়ে ফরমায়েশি বই লেখানো হবে, তারও একটা তালিকা সে করেছিল। আলাপ-আলোচনার পর ট্রাস্টি বোর্ডে স্থির হলো যে, এ-ধরনের বই লেখানোর জন্যে কয়েক মাসের বৃত্তি দিয়ে কয়েকজন তরুণকে নিযুক্ত করা হবে এবং যারা তাদের কাজ তত্ত্বাবধায়ন করবেন, তাঁরাও উপযুক্ত সম্মানী পাবেন। এই লক্ষ্যে বিজ্ঞাপন দিয়ে আবেদনপত্র। আহ্বান করা হলো, প্রার্থী বাছাই করতে একটি নির্বাচকমণ্ডলী গঠিত হলো, আমিও তাতে–সদস্য কিংবা সভাপতি হিসেবেই–থাকলাম। প্রার্থীদের সাক্ষাৎকারের সময়ে এক পণ্ডিত একজন প্রার্থীকে এত বেশি নম্বর দিলেন যে, আমরা বাকিরা পরস্পরের দিকে তাকাতে থাকলাম এবং সকল শিষ্টাচার ভঙ্গ করে আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম যে, সত্যিই তিনি ওই প্রার্থীকে অত নম্বর পাওয়ার উপযুক্ত বিবেচনা করেন কি না। সত্যি সত্যি উপযুক্ত মনে করলে ভদ্রলোকের উচিত হতো আমার কথার প্রতিবাদ করা। তা না করে তিনি শান্তভাবেই বললেন যে, নিজের বিবেচনামতোই নম্বর তিনি দিয়েছেন। বাকিরা সেই প্রার্থীকে কম নম্বর দিলেও যোগফলে সে-ই অগ্রাধিকার পেলো।
আমার তত্ত্বাবধানে দুজন কাজ করেছিল। নজরুলের চিকিৎসা বিষয়ে ডা. গৌতম দত্ত এবং নজরুল-সাহিত্যের নন্দনতাত্ত্বিক বিচার সম্পর্কে সালাহউদ্দীন। আইয়ুব। আর যারা এই গবেষণা-প্রকল্পে কাজ করে বই লিখেছিল, তাদের মধ্যে একজন ছিল শাহনাজ মুন্নী–এখন প্রথিতযশা টেলিভিশন-সাংবাদিক ও ছোটো গল্পকার।
শতবর্ষ-উপলক্ষে নজরুলের বইপত্রের অনেকরকম পুনর্মুদ্রণ হয়েছিল নজরুল ইন্সটিটিউট থেকে। মুদ্রাকরেরা স্বনামে-বেনামে টেন্ডার দিয়ে কূল পাচ্ছিল না। ইন্সটিটিউটের গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগ খুব ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছিল। নুরুল হুদার ব্যস্ততা ও উৎসাহেরও সীমা ছিল না। উৎসাহবশত সে এমন একটি কাজ করে বসলো যা আমি সংগত বিবেচনা করিনি, কিন্তু বাধা দেওয়ার কোনো সুযোগও পাইনি। সে একটা মস্ত বড়ো সারণি তৈরি করে দেখাল যে, জন্মদিন ও জন্মবার্ষিকী আলাদা। যেদিন কেউ জন্ম নেয়, সেদিনই তার প্রথম জন্মদিন, আর পরের বছর ওই তারিখ হচ্ছে তার প্রথম জন্মবার্ষিকী। বাংলায় জন্মদিন কথাটা ইংরেজি বার্থডের অনুবাদ। বার্থডের মুখ্য অর্থই জন্মবার্ষিকী, নিতান্ত গৌণ অর্থেই যেদিন জন্মায় তা সূচিত করে। যেদিন জন্মায় সেদিন বোঝাতে ডেট অফ বার্থ কথাটাই ব্যবহৃত হয়। রবীন্দ্রনাথের জন্ম ১৮৬১ সালে, তাই ১৯৬১ সালেই বিশ্বব্যাপী তাঁর জন্মশতবর্ষ পালিত হয়েছিল। কিন্তু নুরুল হুদার সারণিতে ১৮৯৯ সালে নজরুলের প্রথম জন্মদিন, ১৯০০ সালে প্রথম জন্মবার্ষিকী। অতএব ১৯৯৯ সালে–যখন কবির শতবর্ষ পালিত হওয়ার কথা–তখন তার ৯৯তম জন্মবার্ষিকী এবং ২০০০ সালে শততম জন্মবার্ষিকী। এমনিতেই ভাবা হয়েছিল, নজরুল জন্মশতবর্ষের অনুষ্ঠান ১৯৯৮তে শুরু হয়ে ১৯৯৯ পর্যন্ত চলবে। নুরুল হুদার গণনায় ২০০০ সালে শতবার্ষিকী পালনীয় হয়ে গেল। অতএব, শতবর্ষ উদ্যাপন চলল ১৯৯৮ থেকে ২০০০ সাল অবধি।