সমস্ত ঘটনার দুটি পাদটীকা আছে। যেসব ছাত্র ১৯৭২ সালে আমার নিয়োগের বিরোধিতা করে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিল, অনেক বছর পর তাদের অন্তত দুজন আমার কাছে নিজেদের আচরণের জন্য ক্ষমা চেয়েছিল এবং অন্তত আরো দুজন তাদের ব্যবহারের দ্বারা বুঝিয়ে দিয়েছিল যে, তারা অনুতপ্ত।
পরবর্তীকালে রাজ্জাক সাহেব কখনো এই ঘটনা নিয়ে আমাকে কিছু বলেননি।
১২.
বাংলাদেশের সংবিধান-প্রসঙ্গে বাকি কথা বলার সময় হয়ে গেছে। সংবিধান প্রণয়নকালীন বিভিন্ন পর্যায়ের খসড়া, বিল আকারে উপস্থাপিত সংবিধানের পাঠ এবং সংবিধান-প্রণয়ন কমিটির রিপোর্টের যে-কপি নিজের কাছে রেখেছিলাম, সৌভাগ্যক্রমে তা পেয়ে গেলাম। এর ফলে অনেক কথা এসবের ওপর নির্ভর করে বলা যাবে এবং স্মৃতিনির্ভর দু-একটা বলা কথাও এই সুযোগে সংশোধন করে নেওয়া যাবে।
সংবিধান-প্রণয়ন কমিটির বৈঠক বসে একাদিক্রমে ১৭ থেকে ২৯ এপ্রিল, ১০ থেকে ২৫ মে, ৩ থেকে ১০ জুন, ১০ আগস্ট থেকে ১ সেপ্টেম্বর এবং ৯ সেপ্টেম্বর থেকে ৩ অক্টোবর। মোট ৮৫ দিন। তৃতীয় দফার বৈঠকে অর্থাৎ ১০ জুনে সংবিধানের একটি পূর্ণাঙ্গ খসড়া অনুমোদিত হয়। পূর্ণাঙ্গ মানে বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে পূর্ণাঙ্গ। তারপরে বাকি রয়ে যায় ইংরেজি ভাষ্যের আইনি দিক এবং বাংলা ভাষ্যের ভাষাগত দিকের উন্নতিসাধন।
১৩ জুন কামাল হোসেন ভারত হয়ে ইংল্যান্ডে রওনা হন। উভয় দেশেই সংবিধান-বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আমাদের প্রস্তাবিত সংবিধানের মূল কাঠামো সম্পর্কে তিনি আলোচনা করেন। আলোচনা যে হয়েছে, সে-খবর কাগজে বের হয়, যদিও তার মর্মবস্তু কী, তা প্রকাশিত হয়নি। এতেই দেশে রটে গেল যে, ভারত সরকারকে দিয়ে সংবিধানের খসড়া অনুমোদন করিয়ে আনতে কামাল হোসেন দিল্লি গেছেন–বিলেত যাওয়াটা আসলে কিছু নয়। প্রকৃতপক্ষে এই যাত্রায় লন্ডনে গিয়েই আইনি খসড়া-প্রণেতা রবার্ট গাথরিকে আমাদের সংবিধান-রচনায় সহায়তাদানের জন্যে নিয়োগ করে আসেন কামাল।
আমরা তিনজন যে ভাষান্তরের কাজ করছিলাম, তার একটা আনুষ্ঠানিক অনুমোদনের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়েছিল। আমার পরামর্শে খসড়া-প্রণয়ন কমিটিকে দিয়ে কামাল একটি ভাষা-বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করিয়ে নিয়েছিলেন–ইংরেজির সঙ্গে বাংলা পাঠ মিলিয়ে এই কমিটি ভাষাগত উন্নতিসাধনের প্রয়োজনীয় সুপারিশ করবে। এই কমিটি গঠিত হয়েছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সৈয়দ আলী আহসান, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মযহারুল ইসলাম ও আমাকে নিয়ে, আমি ছিলাম কমিটির আহ্বায়ক। ৩ থেকে ২০ জুলাইয়ের মধ্যে ১১টি বৈঠক করে (শেষ চারটিতে মযহারুল ইসলাম থাকতে পারেননি) বাংলা পাঠ সম্পর্কে এই কমিটি সুপারিশ প্রদান করে ১৯ আগস্টে।
তখনো ইংরেজি ভাষ্য চূড়ান্ত হয়নি। গাথরি তার কাজ মোটামুটি শেষ করেন সেপ্টেম্বরের ৭ তারিখের দিকে। তিনি অবশ্য যখন যতটুকু সম্পন্ন করছিলেন, তা দিয়ে যাচ্ছিলেন আমাকে। তবু তাঁর পরিমার্জিত ভাষ্য-অনুযায়ী বাংলা পাঠ পরিবর্তন করতে হয়েছিল আমাদের। সংবিধান-প্রণয়ন কমিটির চতুর্থ বৈঠকে মূলত বাংলা পাঠ এবং পঞ্চম বৈঠকে মূলত গাথরির পরিমার্জিত পাঠ চূড়ান্ত করা হয়।
১২ অক্টোবর গণপরিষদের অধিবেশনে বিল-আকারে খসড়া সংবিধান উপস্থাপিত হলো এবং সেই সঙ্গে সংবিধান-প্রণয়ন কমিটির রিপোর্টও পেশ করা হলো। কমিটির ছ জন সদস্যের ভিন্নমতসূচক মন্তব্য রিপোর্টে যুক্ত হয়। এঁদের মধ্যে আ ক মোশাররফ হোসেন আকন্দ সংবিধানের প্রস্তাবনার শুরুতে ‘সর্বশক্তিমান পরম করুণাময় ও দয়াময়ের নামে’ কথাগুলো যুক্ত করার প্রস্তাব করেন। ৪২ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে তিনি আপত্তি করেন এবং ৭০ অনুচ্ছেদ বর্জন করতে চান। ৪২ ও ৭০ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে বড়োরকম আপত্তি করেন। আছাদুজ্জামান খান। তিনি নিজেকে সমাজতন্ত্র কায়েমের বিরোধী নন বলে অভিহিত করে বলেন যে, ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার মৌলিক অধিকার, তার রক্ষাকবচ থাকতে হবে এবং কারো সম্পত্তি রাষ্ট্র অধিগ্রহণ করলে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ৭০ অনুচ্ছেদের বিরোধিতা করে আবদুল মুস্তাকীম চৌধুরী বলেন যে, সাধারণ আইনদ্বারা সাময়িকভাবে এই বিধান রাখা যেতে পারে, এটি সংবিধানের অংশ হওয়া উচিত নয়, সংবিধানে রাখতে চাইলে তা সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে উপস্থিত করতে হবে। তিনি চতুর্থ তফসিলে পরবর্তী নির্বাচনের নির্দিষ্ট তারিখ জ্ঞাপন করার প্রস্তাব করেন। ৭০ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে সবচেয়ে কড়া ভাষায় আপত্তি জানান হাফেজ হাবিবুর রহমান–তাঁর মতে, এতে দলীয় একনায়কত্বের ও দলীয় নেতার একনায়কত্বের সৃষ্টি হবে। তাঁর একটি বড়ো প্রস্তাব ছিল দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠনের–একক হস্তান্তরযোগ্য ভোটে নিম্নপরিষদ ষাটজন সদস্যবিশিষ্ট উচ্চপরিষদ গঠন করবে, অর্থবিল উত্থাপনের একক অধিকার থাকবে নিম্নপরিষদের, বাকি সব বিষয়ে দুই পরিষদের থাকবে সমান ক্ষমতা, কোনো বিল সম্পর্কে দুই পরিষদের মতানৈক্য ঘটলে দুই পরিষদের যুক্ত বৈঠকে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে বিষয়ের মীমাংসা হবে। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রায় পুরো সংবিধান সম্পর্কেই দ্বিমত পোষণ করেছিলেন। রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি থেকে তিনি চার নীতি বাদ দিতে চেয়েছিলেন প্রস্তাবনার পুনরুক্তি হয় বলে; মূলনীতিগুলো যে আদালতের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য নয়, তাতে তিনি আপত্তি করেছিলেন; মৌলিক অধিকারের মধ্যে শোভাযাত্রা, বিক্ষোভ মিছিল পরিচালনা ও ধর্মঘটের অধিকার যোগ করতে চেয়েছিলেন; প্রত্যেক নাগরিকের সীমিত পরিমাণ বা নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পত্তি অর্জন, ধারণ বা বিলিব্যবস্থার অধিকার থাকবে, তবে সম্পদের সামাজিকীকরণের প্রয়োজনে ক্রমান্বয়ে সমুদয় সম্পত্তি বাধ্যতামূলকভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত করা যাবে, এমন বিধান সংযোজন করতে চেয়েছিলেন; তিনি মহিলাদের জন্যে সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থার বিরোধিতা করেছিলেন, তা নারীপুরুষের সমকক্ষতার ধারণার সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ বলে; তিনি সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছরের জায়গায় চার বছর করতে চেয়েছিলেন; আইনজীবীদের মধ্য থেকে বিচারক নিয়োগের বিরোধী ছিলেন তিনি; সংবিধান প্রবর্তনের দিন থেকে মন্ত্রিসভা ভেঙে যাবে এবং ন্যাপ, আওয়ামী লীগ ও কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধি আর নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হবে–এই সরকারই নির্বাচন পরিচালনা করবেন, এমন একটি বিধান সংযোজন করতে চেয়েছিলেন। পেছন ফিরে মনে হয়, সুরঞ্জিতের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ প্রস্তাব ছিল, বাংলাদেশের সকল উপজাতীয় জনগণের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক তথা সামগ্রিক বিকাশের উপযুক্ত ব্যবস্থাগ্রহণ এবং তফসিলি সম্প্রদায়ের অধিকার সংরক্ষণের জন্যে একটি নতুন অনুচ্ছেদ যোগ করা। ক্ষিতীশচন্দ্র মণ্ডল তফসিলি সম্প্রদায়, তফসিলি উপজাতি এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির নাগরিকদের শিক্ষা ও অর্থনৈতিক স্বার্থের উন্নতিবিধানের ব্যবস্থা সন্নিবেশ করতে চেয়েছিলেন রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতিতে।