সেদিন নভেম্বরের ২ তারিখ। আমাদের অগ্রজস্থানীয় বন্ধু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক, জয়নুল আবেদীন দীর্ঘ রোগভোগের পর মারা গেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ-প্রাঙ্গণে বাদ আসর জানাজা। গণপরিষদ ভবন থেকে সেখানে এলাম এবং যেমন ভেবেছিলাম, রাজ্জাক সাহেবকেও পেয়ে গেলাম। জানাজার পরে সারুকে বললাম, আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই।’ উনি। জানতে চাইলেন, গাড়ি আছে? হাঁ-সূচক উত্তর শুনে বললেন, ‘তবে কামালের বাড়ি চলেন। যেতে যেতে আমার কথাটা বললাম। বিবৃতির খসড়া আমার পকেটে ছিল, কামাল হোসেনের বাড়িতে গিয়ে সেটা ওঁর হাতে দিলাম। হামিদাও আমার অভিপ্রায় সমর্থন করলেন। বিবৃতিতে কোন শব্দের প্রয়োগ জুতসই হয়েছে, সেটাই সার বললেন আমাকে; আমার কী করণীয়, সে-বিষয়ে কিছুই বললেন না। জিজ্ঞাসা করলাম, এটা প্রেসে পাঠিয়ে দিই?’ সার বললেন, ‘আপনি তো মন ঠিক কইরাই কাগজটা লিখছেন। আমি সে-রাতেই দৈনিক বাংলা, সংবাদ ও পূর্বদেশে প্রকাশের জন্যে বিবৃতিটা পাঠিয়ে দিলাম। অন্য কোনো কাগজে বেরিয়েছিল কি না, মনে নেই, তবে পূর্বদেশে তা পরদিন ছাপা হয়েছিল। আমার পক্ষে তাই ছিল যথেষ্ট, কেননা আক্রমণাত্মক বিষয়গুলো মূলত পূর্বদেশেই পত্রস্থ হয়েছিল।
আমার বিবৃতিটি ছিল এরকম:
গত দুদিনে কোন কোন সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে এবং একটি মুদ্রিত প্রচারপত্রে স্বনামে ও অনামে আমি উল্লিখিত হয়েছি। এ থেকে বোঝা যায় যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাকে বাংলা বিভাগের অধ্যাপকপদ গ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানাতে পারেন ভেবে অনেকে বিচলিত বোধ করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন পদের জন্য আমি আবেদন করিনি, সেখান থেকে কোন নিয়োগও লাভ করিনি। এই অবস্থায় স্বাভাবিক নিয়মে এ প্রসঙ্গে আমার কিছু বলার কথা নয়। কিন্তু মুদ্রিত বিষয়বস্তুর ভাষার তীব্রতা ও ভাবের গভীরতা এমন পর্যায়ের যে, আমি এই স্বাভাবিক নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটাতে বাধ্য হচ্ছি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের ছাত্র, শিক্ষক ও হিতৈষীদের আমি এই বলে আশ্বস্ত করতে চাই যে, অদূরভবিষ্যতে এরকম নিয়োগগ্রহণের কোনো পরিকল্পনা আমার নেই। আশা করি যে, এই বিবৃতির পরে চরিত্রহননের পালা সাঙ্গ হবে।
এই বিবৃতি দিয়ে আত্মসম্মান রক্ষা করতে পেরেছিলাম কি না জানি না, কিন্তু আমার জন্যে গুরুজনদের সম্মানহানি রোধ করতে পারিনি। সেদিক দিয়ে ওই বিবৃতির সঙ্গে আমার স্বার্থপরতা জড়িত হয়েছিল। তবে উপাচার্যের জন্যে তা একটু স্বস্তিকরও হয়ে থাকতে পারে। তিনি বাংলা বিভাগের অধ্যাপকের দুই পদে নীলিমা ইব্রাহিম ও আহমদ শরীফকে নিয়োগ দিতে পেরেছিলেন। নভেম্বর মাসেই তারা নতুন পদে যোগ দিয়েছিলেন। ততদিনে শুনেছি, প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে তৃতীয় একটি অধ্যাপকের পদও বাংলা বিভাগে সৃষ্টি করা হয়েছিল। তা হতে হতে অবশ্য আমি আর দৃশ্যপটে ছিলাম না।
এই ঘটনা থেকে আরো কিছু ধূলিরাশি সঞ্চারিত হয়েছিল। সেবারে বাংলা বিভাগে এমএ শেষ পর্বের পরীক্ষা কমিটির বহিরাগত সদস্য ছিলাম আমি। সংবিধানের কাজে তখন ঢাকায় ছিলাম। পথে এক ছাত্রের সঙ্গে দেখা। কুশলাদি বিনিময়ের পরে তার কাছে জানলাম, পরদিন এম এ পরীক্ষার্থীদের মৌখিক পরীক্ষা। আমি কিছুই জানতে পারিনি। রাতে ওই কমিটির এক সদস্যকে ফোন। করলাম। তিনি বললেন, তোমার চিঠি বোধহয় চট্টগ্রামে গিয়ে পড়ে আছে, কাল সকালে চলে এসো।’ তাঁরা সবাই জানতেন, আমি ঢাকায় আছি এবং কোথায় আছি। কেউ যোগাযোগ করার চেষ্টা করেননি আমার সঙ্গে। পরে চট্টগ্রামে ফিরে। গিয়েও কোনো চিঠি পাইনি। সেই সদস্যের মৌখিক আমন্ত্রণ পেয়ে বললাম, ‘সকালে পারবো না, লাঞ্চের পর পৌঁছতে পারি।’ তিনি বললেন, পরীক্ষা তো দুদিন ধরে চলবে, তুমি এক বেলা থাকতে না পারলেও আমরা ম্যানেজ করে নেবো। ম্যানেজ করেছিলেন ঠিকই। আমি গিয়ে দেখলাম, ইতস্ততবিক্ষিপ্তভাবে অনেক পরীক্ষার্থীর পরীক্ষা নেওয়া হয়ে গেছে; সকালে-বিকেলে বা পরদিন যাদের পরীক্ষা দেওয়ার কথা, তাদের মধ্যেও অনেকে পরীক্ষা দিয়ে গেছে এবং ভালো নম্বর পেয়েছে। শুনলাম, নানারকম অসুবিধের কারণে নির্দিষ্ট সময়ে এরা আসতে পারবে না, তাই এই ব্যবস্থা। এরকম বিবেচনা সব সময়েই করা হয়। তবে সাধারণত একসঙ্গে এতজনের অসুবিধে ঘটে না। আমি বোধহয় শুধু বলেছিলাম, ‘ভালো ছাত্রেরা সবাই দেখছি আগে পরীক্ষা দিয়ে ফেলেছে। পরদিন দু-বেলা পরীক্ষা। মধ্যাহ্নবিরতির সময়ে যে-যার বাড়িতে খেতে চলে। গেলেন, আমার এতদিনের বন্ধু, হিতৈষী ও সহকর্মীরা কেউ জানতে চাইলেন না, আমি খাবো কি না কিংবা কোথায় খাবো।
চট্টগ্রামে অনার্স ফাইনাল পরীক্ষায় নীলিমা ইব্রাহিম ছিলেন বহিরাগত পরীক্ষক। পরীক্ষার আগের দিনও তাঁর সঙ্গে কথা হয়েছিল, তিনি আসবেন এবং আমার বাড়িতে থাকবেন। আমি নিজেই গাড়ি নিয়ে বিমানবন্দরে গেছি ওঁকে আনতে। উনি আসেননি। শহরে এসে ফোন করে শুনি, উনি সুস্থ নেই। সেদিন সকালে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে পরীক্ষা। বহিরাগত পরীক্ষক ছাড়া মৌখিক পরীক্ষা হয় না। সেখান থেকে ফোনে পরীক্ষা-নিয়ন্ত্রকের সঙ্গে পরামর্শ করে এবং উপাচার্যের অনুমতি নিয়ে সেই কলেজেরই এক শিক্ষককে বহিরাগত পরীক্ষকের জায়গায় অভিষিক্ত করে পরীক্ষা নিলাম।