যশোরে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে গেলাম। যতদূর মনে পড়ে, তার দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন নূরুল হুদা (পরে ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানে নিহত হন)। আমার। পরিচয় দেওয়ায় চিনলেন। আমি যেতে চেয়েছিলাম খুলনায়। তিনি সন্ধ্যার পর দূরপাল্লায় যাত্রা নিষেধ করলেন–কোথায় কখন কী ঘটে, বলা যায় না। তারপর বললেন, তিনি অপেক্ষা করছেন মেজর জলিলকে গ্রেপ্তার করার জন্যে–এই পথেই তার আসার কথা।
চমকে উঠলাম। মাত্র সাতদিন হয় যুদ্ধে আমরা জয়ী হয়েছি। এরই মধ্যে একজন সেক্টর কমান্ডারকে বন্দি করতে বলা হয়েছে তার অধস্তন সামরিক কর্মকর্তাকে! ক্যাপ্টেন হুদা জানালেন, মেজর জলিল প্রধান সেনাপতির আদেশ অমান্য করায় ১০/১১ তারিখেই এই আদেশ দেওয়া হয়েছে।
রাতটা মন খারাপ করেই কাটলো। পরদিন সকালে একাই খুলনা গিয়ে মেজোবুদের সকলের সঙ্গে দেখা করে এলাম। যুদ্ধের ক মাসের মধ্যে বড়ো ভাগ্নিটির বিয়ে হয়ে গেছে–তার বাড়িও ঘুরে এলাম।
খুলনায় নতুন জেলা প্রশাসক কামাল সিদ্দিকীর সঙ্গে দেখা হলে দুটি অভিযোগ শুনতে পেলাম। একটি মেজর জলিল ও তার মুষ্টিমেয় সহযোদ্ধার বিরুদ্ধে অবাঙালিদের সম্পত্তি লুঠপাট ও অবাঙালি মেয়েদের প্রতি অত্যাচারের, অপরটি ভারতীয় সেনাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সম্পদ-অপহরণের। জানলাম, বিষয় দুটি সম্পর্কে তিনি সরাসরি অবহিত করেছেন বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীদের। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে এড়িয়ে একজন ডিসির পক্ষে দেশের ও বিদেশের প্রধানমন্ত্রীকে এরকম চিঠি লেখা শৃঙ্খলাভঙ্গের শামিল বিবেচিত হয়েছিল এবং পরে এ-নিয়ে অনেক গোলযোগ হয়েছিল।
আমার কিন্তু হতবাক ও হতোদ্যম হওয়ার পালা! এসব আবার কী আরম্ভ হলো! খুলনা থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে এলাম যশোরে, তারপর সবাইকে নিয়ে একটু রাত করেই পৌঁছোলাম কলকাতায়।
ফেরার প্রস্তুতি নিতে আরো কটি দিন কেটে গেল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির সাধারণ সম্পাদক দিলীপকুমার চক্রবর্তী স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে বললেন, দেশে ফিরে যাচ্ছেন–হাতে কিছু টাকাপয়সা রাখা দরকার। সমিতি যে-সামান্য টাকা দিতে পারে, আপনাকে তা নিতে বলতে পারি না। ভাই, এই হাজার পাঁচেক টাকা ঋণ হিসেবে নিন, পরে একসময়ে পাঠিয়ে দেবেন।’ এই বলে হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিলেন।
এ-রকম পরিস্থিতিতে অভিভূত না হয়ে পারে, এমন কে আছে! টাকাটা সমিতিরই ছিল, কিন্তু তিনি ধার দিয়েছিলেন নিজের দায়িত্বে। বোধহয় জুন মাসের দিকে, দিলীপদা ঢাকায় এলে, এই ঋণ পরিশোধ করেছিলাম।
৫ জানুয়ারি সকালে আজিজ ও আমি যার যার গাড়িতে পরিবার নিয়ে কলকাতা থেকে রওনা হলাম খুলনায়।
সীমান্ত পেরিয়েই একবার থামলাম। গাড়ি থেকে নেমে বেবী ও আমি দেশের ধুলোমাটি নিলাম দুহাত ভরে।
যে-পথে যাচ্ছি, তার দুপাশের বাড়িঘরে গোলাগুলির চিহ্ন; ভাঙা পুল; বিকল্প পথ; পাকিস্তানিদের তৈরি বাঙ্কার; ভারতীয় বা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ছোটোখাটো ছাউনি। লোকজন কিছু কিছু ফিরছে তখনো; বিধ্বস্ত ঘরের পাশে তুলছে নতুন আশ্রয়; দোকানপাট সাজাচ্ছে নতুন করে। ফুলতলার কাছে পাকিস্তানিদের পরিত্যক্ত একটি ট্যাংক পড়ে আছে। সেদিকে কেউ কেউ কৌতূহলী দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে মাত্র।
খুলনায় বোনের বাড়িতে দুদিন কাটিয়ে ৮ তারিখে আবার দুই গাড়ির বহর ঢাকার পথে। এবারে মেজো দুলাভাই আছেন আমার গাড়িতে। ঢাকার পথ অনেক বেশি দুর্গম মনে হলো। ভাঙা হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচ দিয়ে ফেরিতে নদী পার হলাম। কোথাও নৌকা জুড়ে পন্টুনের মতো করা হয়েছে, তার ওপর দিয়ে গাড়ি পার করার ব্যবস্থা। কোথাও ঝুড়ি-কোদাল নিয়ে মজুররা কাজ করছে তখনো, ইট জোগাচ্ছে গাড়ির চাকার নিচে। জায়গায়-জায়গায় অনেকক্ষণ দেরি হচ্ছে–বেশ ভিড় জমে যাচ্ছে। যেসব জায়গায় এমন ভিড়, সেখানে দোকানও খুলে বসেছে কেউ কেউ। দোকানে রেডিও বেজে চলেছে সর্বক্ষণ।
তখনো সন্ধ্যা হয়নি। এইরকম অপেক্ষায় আছি অনেকে। হঠাৎ জনতার মধ্যে চাঞ্চল্য, উল্লাস, ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি।
কী হয়েছে? বেতারের সংবাদ : বঙ্গবন্ধু মুক্তি পেয়েছেন পাকিস্তানের কারাগার থেকে। রাওয়ালপিন্ডি থেকে তিনি রওনা হয়েছেন অনির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে। সেই মুহূর্তে কী যে আনন্দ আমাদের! সকলে সকলকে জড়িয়ে ধরছেন, কেউ জয়ধ্বনি দিচ্ছেন, কেউ কেঁদে ফেলছেন। অনতিবিলম্বে সেই অনির্দিষ্ট গন্তব্যেরও খোঁজ পাওয়া গেল : লন্ডন।
৮ জানুয়ারি যখন ঢাকায় এসে পৌঁছোলাম, তখন রাত অনেক হয়েছে। প্রথমে গেলাম স্বামীবাগেশ্বশুরবাড়িতে। আমার শ্বশুর আবদুল ওয়াহাবকে দেখলাম, কেমন যেন বদলে গেছেন এই ক মাসে। আশ্চর্য নয় যে, ১৯৭১-এর দিনগুলো সম্পর্কে যে-বই তিনি লিখেছিলেন, তার নাম দিয়েছিলেন ওয়ান ম্যান’স অ্যাগনি (ঢাকা, ১৯৭২) : এটি উৎসর্গ করেছিলেন তাঁর শহীদ অনুজ আবদুল আহাদকে। ভাইয়ের সম্পর্কে যতটাসম্ভব খোঁজখবর করছেন তিনি তখনো। জানেন, তিনি নেই, তবু আশা ছাড়তে পারেন না।
আজিজরা রয়ে গেল স্বামীবাগে। সেখানেই খবর পেলাম, আমার অগ্রজপ্রতিম বন্ধু ও সহকর্মী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক, গিয়াসউদ্দিন আহমদের শার্ট দেখে তার লাশের খানিকটা শনাক্ত করা গেছে এবং পরদিন সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ-প্রাঙ্গণে তা সমাধিস্থ হবে।