ওদিকে হঠাৎ একদিন খবরের কাগজে দেখি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার অস্থায়ী অধ্যাপক-পদ বিজ্ঞাপিত হয়েছে। আমি বিভাগের অধ্যক্ষ, অথচ কিছুই জানি না। গেলাম উপাচার্যের কাছে। বললাম, আর কিছুকাল পরে পদটি বিজ্ঞাপিত হলে বোধহয় ভালো হতো। ইন্নাছ আলী আমার কথা বুঝলেন। বললেন, কেন, পদ যখন খালি হয়েছে, তখন বিজ্ঞাপিত হওয়াই ভালো, আপনি অবশ্যই আবেদন করবেন। সৈয়দ আলী আহসান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়ে চলে যাওয়ায় ওই পদটি অস্থায়ীভাবে শূন্য হয়। যথারীতি আবেদন করলাম। আরো দুজন প্রার্থী ছিলেন। নিয়োগ আমিই পেলাম। একই সঙ্গে মোহাম্মদ আলী হলেন ইংরেজির স্থায়ী অধ্যাপক। আমরা যেদিন নিয়োগপত্র পাই, সেদিনই নতুন পদে যোগ দিতে পারতাম। কিন্তু সপ্তাহের ওই দিনটি শুভকাজের অনুকূল নয় বিবেচনা করে মোহাম্মদ আলী আমাকে অনুরোধ করলেন পরদিন যোগ দিতে। সেদিন আমি যোগ দিলে তার চেয়ে একদিনের জ্যেষ্ঠ হয়ে যেতাম, তবে আমি স্থিতাবস্থা রক্ষার পক্ষে। তাই পরদিন, ১৯৭২ সালের ১৯ আগস্ট অধ্যাপক-পদে যোগ দিলাম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সচিব একদিন আমাকে পাকড়াও করে বললেন, ‘ভিসি আপনার একটা সিভি চেয়েছেন, এই সপ্তাহেই দিয়ে যাবেন। কদিন পরে আমার জীবন তার হাতেই সমর্পণ করলাম। তিনি পাকা লোক, জানতে চাইলেন, ওতে আমার স্বাক্ষর আছে কি না। উত্তর শুনে বললেন, এখনই স্বাক্ষর করে দিয়ে যান।
অক্টোবর মাসের কোনো এক সময়ে নির্বাচকমণ্ডলীর সভা বসলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নীলিমা ইব্রাহিম ও আহমদ শরীফ, রাজশাহী থেকে কাজী আবদুল মান্নান, সরকারি কলেজ থেকে আলাউদ্দিন আল আজাদ। তার ওপর উপাচার্য আমার জীবনবৃত্তান্ত উপস্থাপন। করেছেন। আবদুর রাজ্জাকের মুখে শুনলাম, আমাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।
অন্যেরাও নিশ্চয় এমনই শুনেছিলেন। তার প্রতিক্রিয়া হলো প্রবল। একদল ছাত্র অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে উপাচার্যের বাড়ি চড়াও হলো, নির্বাচকমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রাজ্জাকের ফুলার রোডের বাসায় গিয়েও তার খোঁজ করলো। নির্বাচকমণ্ডলীর আরেকজন সদস্য সৈয়দ আলী আহসানকে ফোন করে গালমন্দ করলো কেউ কেউ, জানতে চাইলো, আমি কেন আমার স্ত্রীকে বিধবা করতে চাই। আমাকে অনেকে পরামর্শ দিলেন বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে দূরে থাকতে। এদিকে অ্যাকাডেমিক কাউনসিলের সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে অধ্যাপকের আরো ২৪টি পদ সৃষ্টি হলো, তার মধ্যে একটি বাংলায়। বাংলা বিভাগে অধ্যাপকের দুটি পদে দুজন নিয়োগ পাবেন–এরকম সম্ভাবনায়ও ক্ষোভ প্রশমিত হলো না–বাড়লো হয়তো। বিভাগে ছাত্রদের আনুষ্ঠানিক সভায় ‘একজন প্রভাবশালী সহকারী অধ্যাপকের প্রিয় পাত্রকে’ ‘পেছন দরজা দিয়ে নিয়োগের চেষ্টার প্রতিবাদ করা হলো, বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষকে স্বজনপ্রীতি, অবৈধ নীতি ইত্যাদি পরিত্যাগ করার আহ্বান জানানো হলো, অন্যথায় সচেতন ছাত্রসমাজ যে চরম ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, সে-সংকল্পও ব্যক্ত হলো। উপাচার্য প্রমাদ গুনলেন। রাজ্জাক সাহেবের অনুরোধ ছাড়াও, তিনি নিজে থেকেই আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আনতে চেয়েছিলেন। অল্প কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী যে আমাকে ঢাকায় নিয়ে আসতে বলেছিলেন তাঁকে, তাও তাঁর মনে। ছিল। এখন দেখলেন, ছাত্রলীগের মধ্যম সারির নেতারাই আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখতে চায় না। অবস্থা এমন হলো যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক সংবাদপত্রে বিবৃতি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে অধ্যাপক-নিয়োগের নীতিমালা ব্যাখ্যা করার দাবি জানালো। তাদের পর্যবেক্ষণ : ‘বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে নোংরা রাজনীতি শুরু হয়েছে। …কেউ কেউ ব্যক্তিগত পদোন্নতি ইত্যাদির আকাঙ্ক্ষায় দলাদলি করার চেষ্টা করছেন। তারা ছাত্রদেরকেও তাদের স্বার্থে ব্যবহার করার চেষ্টা করছেন। কর্তৃপক্ষও কোন প্রকার দৃঢ় ভূমিকা গ্রহণ করছেন না, বরং দলাদলির সুযোগ করে দিচ্ছেন।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের সাধারণ ছাত্রদের নামে মুদ্রিত একটি প্রচারপত্র এ-সময়ে বিতরণ করা হলো। তার ভাষা বেশ অগ্নিগর্ভ। মুজাফফর আহমদ চৌধুরী, মীর্জা নূরুল হুদা, আব্দুর রাজ্জাক ও সৈয়দ আলী আহসান তার আক্রমণের লক্ষ্য–আমি তো আছিই। এবারে আমি বিচলিত না হয়ে পারলাম না। আমার কারণে আমার শ্রদ্ধেয় মানুষেরা এভাবে অপমানিত হবেন, তা আমার কাছে খুবই খারাপ লাগতে লাগলো। ভাবলাম, যথেষ্ট হয়েছে, এবারে জনসমক্ষে একটি বিবৃতি দিয়ে বলা দরকার যে, এই প্রতিযোগিতায় আমি আর নেই। মুজাফফর আহমেদ চৌধুরীকে আমার অভিপ্রায় টেলিফোনে জানালাম। স্বভাবতই উনি ক্ষুণ্ণ হলেন, আমি মাফ চাইলাম। উনি বললেন, ‘ইট ইজ ইওর ডিসিশন, আফটার অল, তবে, প্লিজ, সারের সঙ্গে কথা বলে নেবেন বিফোর ইউ গো পাবলিক।’ সৈয়দ আলী আহসানকে ফোন করলাম–ওঁর কথাও প্রায় তাই। এদিকে রাজ্জাক সাহেবকে বাড়িতে ধরতে পারছি না। একবার গিয়ে পেলাম ওঁর অব্যবহিত কনিষ্ঠ আবদুল খালেককে। তিনি বাড়িতেই বেশির ভাগ থাকেন–ছাত্রদের রোষের ব্যাপারটা স্বচক্ষে দেখেছেন। তিনি আমার সঙ্গে একমত। তবে কারণটা একটু ভিন্ন : আপনার সারের বউ-বাচ্চা নাই, দুনিয়াদারির খবর নাই–তার কথা আলাদা। আপনে ক্যান এই রিস্কের মধ্যে যাইবেন? যা দিনকাল, বলা যায় না।’