মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রণয়নের ভার দেওয়া হলো বাংলা একাডেমিকে। তার জন্যে অনেক অস্থায়ী নিয়োগের ব্যবস্থা হলো। এই প্রকল্পের জন্যে যে-কমিটি গঠিত হলো, কপালগুণে আমি তারও সদস্য। সব সভায় আসতে পারি না, এলেও সবকিছু বুঝতে পারি না। এক সভায় কমিটির আরেক সদস্য সিকান্দার আবু জাফর ক্রুদ্ধ হয়ে মহাপরিচালককে (তিনিই প্রকল্প-পরিচালক) কীসব বললেন, আর জানালেন, তাকে বঙ্গবন্ধু সদস্য করেছেন এখানে কোনো অনিয়ম হচ্ছে কি না দেখতে। মাঝপথে সভা শেষ হলো। জাফর ভাই তাঁর গাড়ির গ্লাভ কম্পার্টমেন্ট থেকে একটা ছোটো বোতল বের করে তার গর্ভস্থ পানীয় গলায়। ঢালতে ঢালতে বললেন, ‘শোন, যা উচিত মনে করবি, তা বলবি। মাস্টার বলে খাতির করবি না, বাপকেও উচিত কথা বলতে ছাড়বি না।’
১১.
অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ণ অধ্যাপক হননি। ১৯৩৬ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছিলেন লেকচারার ক্লাস টু পদে। ক্লাস ওয়ান আর ক্লাস টু লেকচারার পদ যখন মিশে লেকচারার হয়ে গেল, তখন তিনি লেকচারার হলেন। তারপর যখন সিনিয়র লেকচারার নামে নতুন শ্রেণির পদ সৃষ্ট হলো। ১৯৬৫ সালে, তখন আমাদের সঙ্গে তিনিও হয়ে গেলেন সিনিয়র লেকচারার। স্বাধীনতার পরে সিনিয়র লেকচারারের নাম বদলে হলো অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর। অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ চৌধুরী উপাচার্য নিযুক্ত হওয়ায় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সর্বজ্যেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে রাজ্জাক সাহেব হলেন বিভাগের অধ্যক্ষ।
আব্দুর রাজ্জাক কখনো উচ্চপদে নিয়োগলাভের আবেদন করেননি। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যক্ষ কে জে নিউম্যান একবার রিডার পদে খালিদ বিন সাইদের নিয়োগে বাধা দেওয়ার উদ্দেশ্যে রাজ্জাক সাহেবকে ওই পদের প্রার্থী হতে বলেছিলেন এবং এও বলেছিলেন যে, তাঁর প্রার্থিতা তিনি সমর্থন করবেন। রাজ্জাক সাহেব বলেছিলেন, খালিদ বিন সাইদের পিএইচডি আছে, আমার নেই; তুমি তার বদলে আমাকে সমর্থন করতে চাও–তার মানে তুমি লোক সুবিধার নও। তাঁদের দুজনের বিরোধের বোধহয় শুরু এইখানে। মুজাফফর আহমদ চৌধুরী উপাচার্য হয়ে রাজ্জাক সাহেবকে অধ্যাপক করার একটা উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তার প্রবল আপত্তি দেখে শেষে নিরত হন।
আমি একবার রাজ্জাক সাহেবকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ডিগ্রিকে তিনি অত মূল্য দেন কেন? কত মেধাহীন মানুষও তো পিএইচ ডি ডিগ্রি অর্জন করে থাকে। তিনি বলেছিলেন, তা করে, কিন্তু অন্য কোনো নির্ভরযোগ্য মানদণ্ডের অভাবে ওই কাগজগুলোকে মূল্য দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। অন্যথায় সিদ্ধান্ত খেয়ালখুশিমাফিক হয়ে পড়বে।
মুজাফফর আহমদ চৌধুরী গুরুর প্রতি খুব শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। ১৯৭২ সালে আব্দুর রাজ্জাক কেবল রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যক্ষ হলেন না, সিন্ডিকেটের সদস্য হলেন, অনেকগুলো বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপকপদে নির্বাচকমণ্ডলীর সদস্য হলেন। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা সম্পর্কে তিনি অনেককাল ধরেই ভাবনাচিন্তা করে এসেছেন। যেমন, এখানে প্রশাসনিক পদ কমানো উচিত, নিজস্ব প্রকৌশল বিভাগ না রেখে তার কাজের দায়িত্ব চুক্তির ভিত্তিতে বাইরের প্রতিষ্ঠানকে দিলে আর্থিক সাশ্রয় হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব আয় বাড়ানো দরকার। উপাচার্যকে যে তিনি এসব বিষয়ে পরামর্শ দিতেন, তা সবাই জানতো। এসব পরামর্শ বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করেননি উপাচার্য, কিন্তু তাতেও রাজ্জাক সাহেবের প্রতি অনেকের ক্ষোভ প্রশমিত হয়নি।
তিনি আরো চেয়েছিলেন যে, পাকিস্তান আমলে রাজনৈতিক কারণে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা ত্যাগ করেছিলেন বা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন, তাদের ফিরিয়ে আনা হোক। সরদার ফজলুল করিম দর্শনের শিক্ষক ছিলেন, তাঁকে তিনি নিয়ে এলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানে। এ-নিয়ে কিছু সমালোচনা হলো, কিন্তু তা সামান্যই। বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর সমাজতত্ত্ব বিভাগ থেকে কর্মচ্যুত হয়েছিল আইয়ুব খানের সামরিক শাসনামলে। তার ডিগ্রি ছিল রাষ্ট্রবিজ্ঞানে, সেখানেই তাকে ফিরিয়ে আনা হলো। সে একটু বেশি বাধার সম্মুখীন হয়েছিল এই অর্থে যে, এক তরুণ শিক্ষক তাকে পিস্তল দেখিয়ে অনুরোধ করেছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ না দিতে। বদরুদ্দীন উমর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কর্ম ত্যাগ করেছিলেন তাঁকে নিয়ে তাঁর ভাইস চ্যান্সেলরের ওপরে গভর্নর তথা চান্সেলর এক ধরনের চাপ সৃষ্টি করায়। রাজ্জাক সাহেব তাকেও বিভাগে আনতে চাইলেন–এতে যে উমরের আগ্রহ ছিল, তা নয়। এবারে কাগজে লেখালেখি শুরু হলো যে, একজন নকশালপন্থী ব্যক্তিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে আসা হচ্ছে। অথচ একই কাগজে অন্য প্রসঙ্গে রাজ্জাক সাহেবকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থরক্ষাকারী কিংবা সিআইএর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বলেও অভিহিত করা হয়।
আমার প্রতি স্নেহবশত রাজ্জাক সাহেব চাইলেন, আমিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসি। ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাসে বাংলা বিভাগে অধ্যাপক-পদপূরণের লক্ষ্যে বিজ্ঞপ্তি বের হলো। সার আমাকে দরখাস্ত করতে বললেন। আমি বললাম, আমি চট্টগ্রামে গেছি এখনো তিন বছর হয়নি–এখন ঢাকায় আবার চাকরির আবেদন করলে অস্থিরচিত্ততার পরিচয় দেওয়া হবে মাত্র। আমি দরখাস্ত না করায় রাজ্জাক সাহেব পরামর্শ দিলেন, নির্বাচকমণ্ডলীর সভায় উপাচার্য যেন আমার নামটাও বিবেচনা করতে বলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম-অনুযায়ী আবেদনকারীদের বাইরেও কারো বিষয় নির্বাচকমণ্ডলীকে বিবেচনা করতে বলার অধিকার উপাচার্যের ছিল।