আলাওল হলের নির্বাচন স্থগিত করা হলো, তবে কেন্দ্রের ও আমার হলের নির্বাচনের কাজ চলতে থাকলো। ভোটগণনায় দেখা গেল, কেন্দ্রে জয়ী হয়েছে ছাত্র ইউনিয়ন (শামসুজ্জামান হীরা সহ-সভাপতি), এ এফ রহমান হলে ছাত্রলীগ (গোলাম জিলানী সহ-সভাপতি, নূরনবী সাধারণ সম্পাদক)। উপাচার্য নির্দেশ দিলেন আমাকে, নির্বাচনের ফল যেন ঘোষণা না করি। তাঁর সঙ্গে প্রোভোস্ট, প্রক্টর ও কয়েকজন শিক্ষকের বৈঠকে স্থির হলো, আলাওল হলের ভোটগ্রহণের বিষয়টা স্থির না হওয়া পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সংসদ ও হল সংসদের নির্বাচনের ফল দেওয়া হবে না। আমি এটা সংগত মনে করলাম না, কিন্তু সিদ্ধান্ত মেনে নিলাম।
এদিকে ছাত্র ইউনিয়নের বিজয়ী প্রার্থীরা সংসদের দায়িত্ব নিতে উন্মুখ, ওদিকে ছাত্রলীগ যদিও আলাওল হলের নির্বাচনের পরে ফলপ্রকাশের পক্ষপাতী তবু আমার হলে যারা নির্বাচিত হয়েছে, তারা হাসি-হাসি মুখ করে রোজ একবার দেখা করে। দু-তিন দিন পরে আমি উপাচার্যকে বললাম, সংসদ নির্বাচনের ফল ঘোষণা না করার মতো কোনো আইনগত কর্তৃত্ব আমার আছে বলে মনে করি না, তাই তিনি অনুমতি দিলে আমি আনুষ্ঠানিকভাবে ফল ঘোষণা করতে চাই। অধ্যাপক ইন্নাছ আলী আমার কথাটা বুঝলেন। সম্পূর্ণ সন্তুষ্টচিত্তে না হলেও তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে, তাহলে আমিও চাকসুর রেজাল্ট অ্যানাউন্স করে দেই।
আমার খুব মজা লেগেছিল যখন একজন প্রবীণ শিক্ষক আমাকে বললেন যে, এ এফ রহমান হলের নির্বাচনে ছাত্রলীগের বিজয় একেবারেই অপ্রত্যাশিত, কেননা, তিনি ওটাকে ছাত্র ইউনিয়নের ঘাটি বলে মনে করতেন। বুঝলাম, তিনি ভেবেছেন, আমি বেছে বেছে ছাত্র ইউনিয়নের সমর্থকদের হলে নিয়েছি।
নিজের উদ্যোগে আসলে আমি মাত্র কয়েকজন ছাত্রকে আমার হলে নিয়ে এসেছিলাম। এদের সবাই অনার্স পরীক্ষায় খুব ভালো করেছিল, কিন্তু আলাওল হলের একটা বর্ধিত অংশে এরা থাকছিল একটু কষ্টে। আমি তাদের বলেছিলাম, এ এফ রহমান হলে তারা বদলি নিয়ে এলে আমি তাদের সিংগল সিট দিতে পিরবো। তারা এসেছিল। তাছাড়া, ৬০ শতাংশ সিট আমি বরাদ্দ করেছিলাম মেধার ভিত্তিতে, প্রার্থীদের তালিকা তাদের দেখার জন্য উন্মুক্ত রেখেছিলাম; আমাদের হিসাবে কোনো ভুল আছে কি না, তা তারা দেখতে পারতো এবং আর কতজনের পর একজনের পালা আসবে, তাও জানতে পারতো। ৪০ শতাংশ সিট রেখেছিলাম বিভাগের অধ্যক্ষের সুপারিশে ভর্তি করার জন্যে। দূরদূরান্ত থেকে আগত কিংবা বিশেষ বিবেচনা করার যোগ্য প্রার্থীরা বিভাগের মাধ্যমে এভাবে সুযোগ পেতে পারতো। অনেক বিভাগের অধ্যক্ষ অবশ্য এ-ব্যবস্থায় খুশি হননি, তারা এটা বাড়তি ঝামেলা মনে করেছিলেন। তবে আমি যে নিজস্ব বিবেচনার জন্যে কিছু হাতে রাখিনি, তা ছিল স্পষ্ট। তাতে অনেক বন্ধু ও পরিচিতজনের অনুরোধ রাখতে পারিনি, তাঁরা দুঃখিত হয়েছিলেন। এরপরও যারা মনে করেছিলেন, বিশেষ কোনো ছাত্র-সংগঠনের প্রতি আমি পক্ষপাত করেছি, এ-বিষয়ে প্রমাণ বা যুক্তির চেয়ে তাঁদের বিশ্বাসই ছিল বড়ো।
১০.
শিক্ষামন্ত্রী মোহাম্মদ ইউসুফ আলীর সঙ্গে অধ্যাপক মযহারুল ইসলামের বন্ধুত্ব ছিল। মযহারুল ইসলাম তাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন বাংলা একাডেমি ও কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড একীভূত করতে। বিষয়টি বিবেচনার জন্যে সরকার একটি কমিটি গঠন করে। বাংলা একাডেমির পরিচালক (কবীর চৌধুরী), ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ (যথাক্রমে নীলিমা ইব্রাহিম, মযহারুল ইসলাম ও আমি), শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (আ. কা. মো. যাকারিয়া) এর অন্তর্ভুক্ত। বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের গ্রিন রোডের বাড়িতে দুদিন সভা হলো। প্রথম সভায় উপস্থিত হয়ে দেখি, দুই প্রতিষ্ঠান একীভূত করার। উদ্দেশ্যে আইনের একটি খসড়া আমাদের বিবেচনা করতে দেওয়া হয়েছে। কবীর চৌধুরী ও আমি আপত্তি করলাম। আমরা বললাম, বিষয়টির নীতিগত দিক আলোচনা করার আগে আইনের খসড়া দেখবো কেন? দুটি প্রতিষ্ঠানের চরিত্র দুরকম–দুটিকে এক করা সংগত কি না, আগে তো তা নিয়ে আলোচনা করতে হবে। একজন বললেন, দুটো প্রতিষ্ঠান এক হোক, এটা বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছা। কবীর চৌধুরী বললেন, বঙ্গবন্ধুকে যথাযথ পরামর্শ দেওয়া আমাদের কর্তব্য। যাকারিয়া বললেন, ‘একত্রীকরণের বিষয় একরকম স্থির হয়ে গেছে, আপনারা এই খসড়ায় কিছু পরিবর্তন আনতে চান কি না দেখুন।’ আমি বললাম, আমরা আইনজ্ঞ নই, আইনের খসড়া দেখে কী করবো? আমি মনে করি, দুটি প্রতিষ্ঠান। স্বতন্ত্র থাকাই সংগত। যাকারিয়া মৃদু হাসলেন।
আমি দ্বিতীয় সভায় আর গেলাম না। সুতরাং কোনো সুপারিশে স্বাক্ষর করিনি। তাতে অবশ্য কিছু আসে যায়নি। বাংলা একাডেমির সঙ্গে বাংলা উন্নয়ন বোর্ড এক হয়ে গেল। এতদিন বাংলা একাডেমির একজন পরিচালক ছিলেন, এবারে একজন মহাপরিচালক ও কয়েকজন পরিচালকের পদের সৃষ্টি হলো। মযহারুল ইসলাম মহাপরিচালক হলেন। মিলিত বাংলা একাডেমিতে পূর্বতন দুই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের মধ্যে কে কার চেয়ে কর্মে জ্যেষ্ঠ, এই সমস্যার সমাধান হতে অনেকদিন লেগে গেল। সংবাদপত্রে খবর বের হলো, এই দ্বন্দ্বে বাংলা একাডেমিতে কাজকর্ম সব বন্ধ হয়ে আছে।