এর আগে দেশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় ও হল সংসদগুলোর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়ন জয়ী হয়, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম সহ-সভাপতি এবং মাহবুব জামান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়। প্রকৌশল ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্র ইউনিয়ন সাফল্যলাভ করে। ক্যাম্পাসে কয়েকদিন ধরে উপর্যুপরি গোলাগুলির কারণে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচন স্থগিত রাখতে হয়। আমাদের ধারণা হয়, ছাত্রলীগের কর্মীরাই ওরকম পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল। সেখানে নির্বাচন হয় মাসখানেক পরে, কিন্তু তা নির্বিঘ্ন হয়নি।
উত্তেজনাটা আগে থেকেই তৈরি হচ্ছিল। আমি তখন এ এফ রহমান হলের প্রোভোষ্ট। মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের সময়ে আমি হল অফিসে উপস্থিত ছিলাম। হল সংসদের নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসার ছিলেন হাউজ টিউটর রণধীর বড়ুয়া। তিনি আমাদের বিভাগেই পালির শিক্ষক ছিলেন। অত্যন্ত মৃদু স্বভাবের সজ্জন মানুষ, খুবই কর্মনিষ্ঠ ও পরিশ্রমী। একবার বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের কাছে সকল শিক্ষকের নাম ও শিক্ষাগত যোগ্যতার একটা ফর্দ পাঠাতে হয়েছিল। রণধীর বড়ুয়া একটা কাগজে লিখে দিয়েছেন, তিনি পালিতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ। আমি তাকে বললাম, রণধীরবাবু, আপনার না একটা আমেরিকান এম এড ডিগ্রি আছে? উনি বিব্রত হয়ে পালটা জিজ্ঞেস করলেন, ‘সেটাও লিখে দেবো?’ এহেন মানুষকে এই দুর্দিনে এমন ঝামেলা সইতে হলো, কেননা, হাউজ টিউটরদের মধ্যে তিনিই সিনিয়র। মনোনয়ন বাছাই শেষ করে রণধীরবাবু একটু ভীতভাবে আমার কক্ষে প্রবেশ করলেন। বললেন, ‘ছাত্রলীগের ক্রীড়া-সম্পাদকের মনোনয়নপত্র বাতিল করেছি তাতে ক্যান্ডিডেটের সই নেই বলে, কিন্তু ওরা মানতে চাইছে না। মানতে না চাইবার কোলাহল অফিসঘরে বসেই আমি শুনতে পাচ্ছিলাম; ব্যাপারটা যে কী, তা বুঝতে পারিনি। রণধীরবাবুকে বললাম, আপনি ওদের বলুন, আপনার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হল সংসদের সভাপতির (অর্থাৎ প্রোভোস্টের) কাছে আপিল করতে, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। আমি দেবো।’ খবর পেতে থাকলাম, ছাত্রলীগ-নেতারা ওই মনোনয়নপত্রই বৈধ ঘোষণার দাবি জানাচ্ছে; প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্র ইউনিয়ন-প্রার্থীর কাছ থেকে তারা এই মর্মে একটা চিঠি আদায় করেছে যে, অপর প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণা করলে তার কোনো আপত্তি থাকবে না। এবারে ঘর থেকে আমাকে বেরোতেই হলো। ছাত্রদের বললাম, ‘রিটার্নিং অফিসার যথারীতি কাজ করেছেন, তোমরা তাঁর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে নিয়মমাফিক আমার কাছে আপিল করতে পারো, শেষ সিদ্ধান্ত আমার। তারা আমাকে বললো যে, তারা সহযোগিতা ও বন্ধুত্বমূলক প্রতিযোগিতার মনোভাব নিয়ে নির্বাচন করতে চাইছে; মানুষমাত্রের ভুল হয়, প্রার্থী খেলাধুলা যত বোঝে, নিয়মকানুন তত বোঝে না; বেচারা একটা সই করতে ভুলে গেছে, এর বেশি তো কিছু নয়; তার নমিনেশন পেপার ভ্যালিড ঘোষণা করলে প্রতিপক্ষের যেখানে আপত্তি থাকবে না, সেখানে রিটার্নিং অফিসার শুধু শুধু আমলাতান্ত্রিক মনোভাব দেখাচ্ছেন; নিয়ম মানুষের জন্যে, না নিয়মের জন্যে মানুষ? আমি বললাম, ‘তোমরা ওঁকে ওঁর মতো কাজ করতে দাও–আমার কাছে আপিল করলেই কেবল বিষয়টা নিয়ে তোমাদের সঙ্গে কথা বলতে পারি, তার আগে নয়। আমার কথায় কোলাহল কমলো না, কিন্তু রিটার্নিং অফিসারের ওপরে চাপ কমলো। অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রার্থী আপিল করলো। রিটার্নিং অফিসারের সিদ্ধান্ত বহাল রেখে আমি আপিলের মীমাংসা করলাম। সংক্ষুব্ধ ছাত্রেরা আমাকে তাদের আবেদন পুনর্বিবেচনা করতে বললো। আমি যখন তাতে সম্মত হলাম না, তখন হইচই বাড়লো মাত্র। হলের দারোয়ান ছুটতে ছুটতে এসে খবর দিলো যে, অদূরে কয়েকজন অস্ত্রধারী অপেক্ষা করছে, আমি যেন হল থেকে বের না হই। হাউজ টিউটররা আমাকে ঘিরে ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে রইলেন। এর মধ্যে উৎকণ্ঠিত হয়ে উপাচার্য ফোন করলেন, তাঁর কানেও কী সব কথা পৌঁছেছে। আমি তাকে বললাম, একটু পরে তার অফিসে এসে সব জানাবো। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবার পর সকলের মতের বিরুদ্ধে আমি বের হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার আরদালি গাড়ি চালাতো। তাকে প্রস্তুত থাকতে খবর দিয়ে আমি অফিস থেকে বারান্দায় পা দিলাম। আমাকে কেউ বাধা দিলো না বটে, কিন্তু এত ছাত্র আমার সামনে-পেছনে চলতে থাকলো যে গাড়িতে ওঠা আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো। আমি ছাত্রদের বললাম, ‘তোমরা সারারাত আমাকে বসিয়ে রাখতে পারো, কিন্তু সিদ্ধান্ত পালটাবে না। ভাইস-চান্সেলর আমার জন্যে অপেক্ষা করছেন, আমি তার কাছে যাবো, তোমরা আমার পথ ছেড়ে দেবে। এতক্ষণে নেতৃস্থানীয় কজন ছাত্র এসে আমার বেরোবার পথ করে দিলো, তবে তারাও জানাতে কসুর করলো না যে, পুরো ব্যাপারটায় তারা দুঃখিত হয়েছে।
উপাচার্যকে পরিস্থিতি জানালাম। তিনি সত্যিই উদবিগ্ন। কয়েকজন শিক্ষক ও কর্মকর্তাকে দুটি গাড়িতে আমার গাড়ির সামনে-পেছনে দিয়ে ঘুরপথে তিনি আমাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন।
ভোটগ্রহণের ব্যবস্থা হলো প্রশাসন-ভবনের নিচে বাণিজ্য বিভাগের শ্রেণিকক্ষে। প্রত্যেক ঘরে তিনটি করে ব্যালট-বাক্স–কেন্দ্রীয় সংসদের, আলাওল হল সংসদের এবং এ এফ রহমান হল সংসদের। দুই হলের ছাত্রছাত্রীদের ভাগ করে বিভিন্ন কক্ষে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা। সবকিছু ভালো মতোই চললো। দুপুরে বাড়ি গেছি খেতে। একটু পরে খবর এলো, কয়েকজন অস্ত্রধারী ভোটকক্ষে ঢুকে একটা ব্যালট-বাক্স ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। দ্রুত অকুস্থলে ফিরে এলাম। দেখা গেল, আলাওল হল সংসদের একটা ব্যালট বাক্স নেই। সহকর্মীরা বললেন, এ এফ রহমান হলের বাক্স নিতে ভুল করে আলাওল হলের বাক্স নিয়ে গেছে। আলাওল হলে ছাত্রলীগের বিজয় সুনিশ্চিত, এ এফ রহমান হলে পরাজয়ের আশঙ্কা, অতএব। আমি যখন বাণিজ্য বিভাগের কাছে পৌঁছোলাম, তখন দেখি, এক নিষ্ঠাবান কর্মী মাথার ওপরে বন্বন্ করে লাঠি ঘোরাচ্ছে–কাউকে আঘাত করছে না–তবে লাঠির আওতার মধ্যে কেউ যেতেও পারছে না। আমাকে দেখে সে বেশ সম্ভ্রমের সঙ্গে অভিবাদন করলো : লাঠির গতি কমিয়ে সেটাই কপালের মাঝখানে ধরে মাথা একটু নত করলো। তাকে কিছু বলার আগেই, ঘটনার হোতা বলে সন্দেহ করা হয়েছিল এমন এক ছাত্রনেতা কোত্থেকে আবির্ভূত হয়ে বললো, ভোট দিয়ে সে হলে গিয়েছিল একটু বিশ্রাম নিতে, এই অভাবিত ঘটনার বিবরণ শুনে এখনই দৌড়ে আসছে; সে একেবারেই বিমূঢ়, তবে শিক্ষকরা যা বলবেন তা করতে সে এবং তার দল প্রস্তুত।