শিক্ষা কমিশন নানা বিষয়ে অনুধ্যান কমিটি গঠন করেছিল এবং তাতে খ্যাতনামা বিশেষজ্ঞদের জড়িত করেছিল। এঁদের মধ্যে অনেকে আগ্রহ করে কাজ করেছিলেন, অনেকে ছিলেন উদাসীন। কেউ কেউ আমাকে বলেছিলেন, কমিটির সদস্যেরা সব কাজ করে দেবে, আর কৃতিত্বের ভাগ নিয়ে যাবেন কমিশনের সদস্যেরা–দিস ইজ নট ফেয়ার। শিক্ষা কমিশনের খণ্ডকালীন সদস্যের কাজ করা ছাড়াও ছাত্রকল্যাণ ও জাতীয় সেবা-সম্পর্কিত অনুধ্যান কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্ব আমাকে পালন করতে হয়েছিল। সেখানেও এক তৃতীয়াংশ সদস্যের কোনো ভূমিকা ছিল না।
শিক্ষা কমিশন জনসাধারণের কাছ থেকেই উল্লেখযোগ্য সাড়া পায়নি। আমরা একটা প্রশ্নমালা তৈরি করেছিলাম, তা পাঠানো হয়েছিল ৯,৫৫১ জনের কাছে, জবাব পাওয়া গিয়েছিল ২,৮৬৯ জনের কাছ থেকে অর্থাৎ এক তৃতীয়াংশেরও কম প্রাপকের কাছ থেকে। আনুপাতিক হারে সবচেয়ে বেশি সাড়া দিয়েছিলেন মাদ্রাসার সুপারিটেনডেন্টরা-৩০৩ জনের মধ্যে ১৫৯ জন। সবচেয়ে উদাসীন ছিলেন গণপরিষদের সদস্যেরা–৩১৫ জনের কাছে প্রশ্নমালা পাঠানো হয়, ২৯ জন মাত্র জবাব দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও অধ্যাপক এবং ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ ও অধ্যাপকদের ৩০৩ জনের মধ্যে জবাব পাওয়া গিয়েছিল ৮৯ জনের কাছ থেকে। ছাত্র-সংসদ ও ছাত্র সংস্থার কাছে প্রেরিত ২১০টি প্রশ্নমালার মধ্যে জবাবসুদ্ধ ফিরে এসেছিল চারটি মাত্র। তবে সে চারটিই যত্নের সঙ্গে লিখিত হয়েছিল।
কমিশনের সুপারিশের কথা যখন বলব, তখন এর কাজের কথা আরো বলতে হবে। এত রকম প্রতিকূলতার মধ্যেও শিক্ষা কমিশন যতটুকু করতে পেরেছিল, তাকে শ্লাঘনীয় বলতে আমার এতটুকু দ্বিধা নেই। এর মূলে কুদরাত এ-খুদার নেতৃত্ব বড়ো ভূমিকা পালন করেছিল। তাঁর নিষ্ঠা, একাগ্রতা ও কষ্টস্বীকারের তুলনা হয় না।
৯.
স্বাধীনতালাভের পরে ছাত্রনেতাদের, বিশেষ করে, ছাত্রলীগের নেতাদের প্রভাব খুব বেড়ে যায়। বঙ্গবন্ধু ছাড়া আর কোনো জাতীয় নেতার প্রতি তখন তাদের কোনো শ্রদ্ধাবোধ প্রকাশ পায়নি এবং সরকারের বাইরে একটা বড়ো সমান্তরাল শক্তিকেন্দ্র গড়ে তোলার প্রয়াস তাদের কাজকর্ম ও কথাবার্তায় ধরা পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি আ স ম আবদুর রব ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদুস মাখন আর ছাত্রলীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী ও সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ সাধারণ্যে পরিগণিত হয়ে ওঠে চার খলিফা বলে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ছাত্র ইউনিয়নের ভাবমূর্তি আরো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে এবং ক্ষমতাকেন্দ্র থেকে তাদের অবস্থান দূরে থাকায় সে ভাবমূর্তিকে মালিন্য স্পর্শ করে না। বোধহয় এপ্রিল মাসেই ছাত্র ইউনিয়ন প্রস্তাব দেয় ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন মিলে একটি ছাত্রসংগঠন গড়ে তোলার। পঞ্চাশের দশকে একবার এরকম প্রচেষ্টা হয়েছিল, তাও কমিউনিস্ট পার্টির নীতিগত সিদ্ধান্তের কারণে। এরকম সিদ্ধান্তের ফলেই তখন জহির রায়হান ছাত্রলীগে যোগ দিয়েছিল যাতে ঐক্যপ্রয়াসে ওই সংগঠনের ভেতর থেকে সমর্থন পাওয়া যায়। সেবারের উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছিল মূলত ছাত্রলীগের মনোভাবের। জন্যে। এবারও ছাত্র ইউনিয়নের ঐক্যের আহ্বান ছাত্রলীগ ফিরিয়ে দেয়।
কিন্তু তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার যা ঘটে, তা ছাত্রলীগের মধ্যে বিভেদ। এ-বিভেদের অঙ্কুর, মনে হয়, মুক্তিযুদ্ধের সময়েই উদ্গত হয়েছিল। এখন, ১৯৭২ সালের গোড়ায়, নূরে আলম সিদ্দিকী ও মাখন একদিকে, আর রব ও শাহজাহান সিরাজ অপরদিকে নিজেদের অনুসারীদের নিয়ে ভাগ হয়ে গেল। ছাত্রলীগে থেকেই প্রথমোক্তরা গঠন করলো স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী, তাদের লক্ষ্য। দেশে মুজিববাদের প্রতিষ্ঠা; শেষোক্তরা পরিচয় দিলো জয় বাংলা বাহিনী বলে, তাদের উদ্দেশ্য বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রমতে দেশকে গড়ে তোলা। একটু-একটু করে দু-দলের মতপার্থক্য সবার কাছে ধরা পড়তে লাগলো। প্রথমদিকে উভয় পক্ষই ছিল বঙ্গবন্ধুর আশীর্বাদপ্রার্থী। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রীরা তো একসময়ে বঙ্গবন্ধুকে আহ্বান জানালো দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে সর্বময় ক্ষমতা গ্রহণ করতে, সর্বদলীয় বিপ্লবী সরকার গঠন করতে এবং গণপরিষদ ভেঙে দিয়ে একক দায়িত্বে দেশকে সংবিধান দিতে। এ আহ্বান, আর যাই হোক, গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাপ্রসূত ছিল না। শ্রমিক লীগের একাংশ অন্তত এই প্রস্তাব সমর্থন করে; তার মানে, সেখানেও দ্বিধাবিভক্তির সূচনা হয়। ছাত্রলীগের অপর পক্ষ এই বক্তব্যের প্রবল বিরোধিতা করে। জুলাই মাসে ছাত্রলীগের দুই অংশ একই সময়ে দুটি সম্মেলন করে। নূরে আলম-মাখনরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে, রব-শাহজাহানেরা পল্টনে। উভয় পক্ষের আমন্ত্রণ পেলেও বঙ্গবন্ধু প্রথমটিতে যোগ দেন প্রধান অতিথি হয়ে আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতারাও সেখানে গেলেন। এখন ভাগাভাগি এমন পর্যায়ে চলে গেল যে, অপর পক্ষ ঘোষণা করে দিলো, বর্তমান সরকারকে উৎখাত করাই তাদের আশু লক্ষ্য। কোথায় ছাত্র ইউনিয়ন ছাত্রলীগের মিলনের স্বপ্ন আর কোথায় ছাত্রলীগের দ্বিধাবিভক্তি, সংঘর্ষ, হানাহানি, রক্তপাত!