অবশেষে ১৯৭২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ জাতীয় শিক্ষা কমিশন উদ্ববাধন করলেন। তিনি খুব আবেগময় বক্তৃতা দিয়েছিলেন, সমাজতান্ত্রিক সমাজগঠনের স্বপ্নের কথা বলেছিলেন এবং আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যেন তেমন সমাজের উপযুক্ত নাগরিক তৈরি করতে সমর্থ হয়, সেই লক্ষ্য নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। বক্তৃতা শেষ করে তিনি জানতে চাইলেন, আমাদের কারো কিছু বক্তব্য বা জিজ্ঞাস্য আছে কি না। প্রথমটায় আমি চুপ করে ছিলাম, কিন্তু কেউ কিছু বলছেন না দেখে উঠে দাঁড়ালাম। আমি বললাম, আমার একটি প্রশ্ন ও একটি দাবি আছে। প্রথম কথা, সরকার শিক্ষাখাতে জাতীয় আয়ের কত শতাংশ বরাদ্দ করতে পারবেন, তা যদি আমরা জানতে পারি, তাহলে আমাদের পক্ষে শিক্ষানীতি তৈরি করা সহজ হয়। দ্বিতীয় কথা, শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, ছাত্রসমাজের কাছে গ্রহণযোগ্য না হলে কমিশনের রিপোর্ট সরকার গ্রহণ করবে না। কমিশনের সুপারিশ গ্রহণ করা বা প্রত্যাখ্যান করার অধিকার সরকারের আছে। কিন্তু আমরা এই প্রতিশ্রুতি চাই যে, আমাদের রিপোর্ট–তাতে দ্বিমতপোষক মন্তব্য থাকলে সেসব সুদ্ধ–জনসাধারণ্যে প্রকাশ করা হবে। বঙ্গবন্ধু বললেন, টাকাপয়সার কথা আপনারা ভাববেন না। দেশের জন্য যেটা ভালো মনে করবেন, তেমন শিক্ষাব্যবস্থার সুপারিশ করবেন। আমি ধার করে হোক, ভিক্ষা করে হোক, টাকা জোগাড় করব। অর্থের অভাবে উপযুক্ত শিক্ষা যদি মানুষ না পায়, তাহলে তো সে স্বাধীনতার ফললাভ থেকেই বঞ্চিত হবে। শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টের ভূমিকায়–যা আমরা সই করেছি–কিন্তু তাঁর সেদিনের এ কথাগুলো নেই, বরং তার মুখে যা বসানো হয়েছে, তা তিনি তখন বলেননিঃ আমাদের সীমিত সম্পদের কথা স্মরণ রেখে কমিশন এমন এক দীর্ঘমেয়াদী রূপরেখা প্রণয়ন করবেন যা শিক্ষাক্ষেত্রে সার্থক ও সুদূরপ্রসারী সংস্কার সাধনে সাহায্য করবে। এই অসংগতির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেও কমিশনে আমি কোনো ফল পাইনি। শুনেছি, কমিশন যখন প্রাথমিক রিপোর্ট পেশ করতে যায় (সেদিন আমি উপস্থিত ছিলাম না), তখন সীমিত সম্পদের কথা উঠেছিল।
আমার দ্বিতীয় বক্তব্যের জবাবে বঙ্গবন্ধু সহাস্যে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ সরকার এমন এক সরকার যার কিছুই গোপন থাকে না। এমনকী যে-বিষয় গোপন থাকা উচিত, তাও প্রকাশ পেয়ে যায়। সুতরাং রিপোর্ট প্রকাশের বিষয়ে আপনারা চিন্তা করবেন না।’ আমি আবার উঠে বললাম, ‘না, সেরকম প্রকাশের কথা নয়, সরকারিভাবে ছেপে প্রকাশ করতে হবে।’ বঙ্গবন্ধু একটু অধৈর্য হয়েই বললেন, ‘হবে, হবে, মুদ্রিতরূপে হবে।’
চা খাওয়ার সময়ে বঙ্গবন্ধু আমাকে ডাকলেন, জানতে চাইলেন, আমি এখন কী করছি। আমি একটু অবাক হয়ে দ্রুত জানালাম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছি। তিনি বললেন, আমি বলছি, চট্টগ্রামে কী করছ? ঢাকায় অনেক কাজ পড়ে আছে–ঢাকায় চলে এসো।’ আমি আমতা আমতা করছি দেখে তিনি বললেন, আমি চাই, বাংলায় অনেক কাজ হোক। আমাদের রাষ্ট্রদূতরা যেসব ক্রিডেনশিয়াল দেয় বিদেশে, আমি চাই, সেসব বাংলায় লেখা হবে। তাছাড়া আরো অনেক কাগজপত্র বাংলায় হতে হবে। কনসটিটিউশনের কাজ শেষ হলে এসব কাজে তোমাকে হাত দিতে হবে। এই বলে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মুজাফফর আহমদ চৌধুরীকে তাঁর কাছে ডেকে আনালেন। তাঁকে বললেন, ‘সার, আনিসুজ্জামানকে আমার দরকার। আপনি ওকে ঢাকায় আনার ব্যবস্থা করুন।’ মুজাফফর আহমদ চৌধুরী বললেন, ‘আমি ওঁকে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতেই আনতে চাই। মাঝখানে আমি শুধু ক্ষীণকণ্ঠে বলতে পারলাম, চট্টগ্রামে থেকেও তো আমি সংবিধানের কাজ করছি, বাজেট ও প্ল্যানিংয়ের কাজে সাহায্য করছি।’ কথাটা ওখানেই শেষ হলো।
এরপরে গ্রিন রোডের একটা বাড়িতে শিক্ষা কমিশনের কাজ শুরু হয়। কমিশনের কার্যকালে এর গঠনে যে-পরিবর্তন ঘটে, এখানে তারও উল্লেখ করা দরকার। অধ্যাপক মোহাম্মদ ফেরদাউস খান পূর্ণকালীন সদস্য নিযুক্ত হন। ১৯৭৩ সালের মার্চে, সে-বছর জুলাই মাসে কবীর চৌধুরী শিক্ষা-সচিব নিযুক্ত হলে ফেরদাউস খান কমিশনের সদস্য-সচিবের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৭৩ সালের মে মাসের শেষে সুরাত আলী খানের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়। সে-বছর জুনে অধ্যাপক মোহাম্মদ নূরুস সাফা (ঢাকার উচ্চমাধ্যমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান) এবং নভেম্বরে পাকিস্তান-প্রত্যাগত অধ্যাপক এম এ সাত্তার (সিন্ধু ও বেলুচিস্তানের প্রাক্তন কারিগরি শিক্ষা পরিচালক) পূর্ণকালীন সদস্য নিযুক্ত হন। আমার এক সময়ে মনে হয়েছিল যে, শিক্ষা বিভাগের যেসব কর্মকর্তাকে সরকার অন্য কোথাও নিয়োগদান করতে পারছে না, শিক্ষা কমিশনই তাদের একমাত্র ক্ষেত্র হয়ে উঠছে। শিক্ষা কমিশনের কর্মকর্তাদের বেলায় বোধহয় একথা আরো সত্য। কমিশনের কর্মকাল জুড়েই বোধহয় পরিচালক ও সহ-পরিচালক নিযুক্ত হয়ে চলেছিলেন, একজন সহ-পরিচালক নিযুক্ত হন আমাদের রিপোর্ট জমা দেওয়ার একমাস আগে–যখন লেখালিখির সব কাজ শেষ হয়ে গেছে। খণ্ডকালীন সদস্যদের মধ্যে ফজলুল হালিম চৌধুরী ও আবদুল্লাহ আল-মুতী শেষ পর্যন্ত কাজ করতে পারেননি। তাদের জায়গায় নিয়োগ পেয়েছিলেন যথাক্রমে শিক্ষা ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং শিক্ষা সম্প্রসারণ কেন্দ্রের নতুন পরিচালক মুহম্মদ নূরুল হক। অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক দু-একটি সভায় যোগদান করার পর আর আসেননি, এমনকী রিপোর্টে স্বাক্ষরও দেননি। স্বদেশ বসু, মযহারুল ইসলাম এবং এম এ সাত্তারও রিপোর্ট স্বাক্ষর করেননি।