এর মধ্যে মাদ্রাসা-শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আকস্মিকভাবেই যেন হইচই পড়ে গেল। এপ্রিল মাসের শেষদিকে মুদাররেসিনের এক প্রতিনিধিদল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে মাদ্রাসা-শিক্ষার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তাঁদের উদবেগের কথা জানালেন। বঙ্গবন্ধু তাঁদের এই বলে আশ্বস্ত করলেন যে, মাদ্রাসা-শিক্ষা বিলোপ করা হবে না, প্রয়োজনীয় কারিগরি বিদ্যাশিক্ষার ব্যবস্থা যোগ করে মাদ্রাসার পাঠ্যসূচিতে কিছু রদবদল করা হবে মাত্র। বঙ্গবন্ধু আরো বললেন যে, সাধারণ শিক্ষার ক্ষেত্রে ছাত্রেরা যাতে কুরআন-হাদিস সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞানলাভ করে, তারও ব্যবস্থা করা হবে। এ-রকম নীতিগত ঘোষণা তিনি হঠাৎ করে কেন দিলেন, তা ভেবে পেলাম না। শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে প্রথম বৈঠকে তো একই ভাষামাধ্যমে একই পদ্ধতির শিক্ষাব্যবস্থা-প্রবর্তনের বিষয়ে একটা মতৈক্য হয়েছিল। পরে শুনলাম–সত্যমিথ্যা জানিনা–মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ মাদ্রাসা-শিক্ষকদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের ব্যবস্থা করেন এবং তিনি বঙ্গবন্ধুকে বোঝান যে, মাদ্রাসা-শিক্ষাব্যবস্থা বহাল রাখতে হবে, নইলে দেশের গ্রামাঞ্চলে এমন প্রতিক্রিয়া হবে যে, সরকার সামাল দিতে পারবেন না। মাদ্রাসা-শিক্ষা বহাল রাখতে যে বড়োরকম তৎপরতা চলছে, তা বোঝা গেল কয়েকদিন পরে মওলানা ভাসানীর এক বক্তৃতায়। তিনি সরকারকে সম্বোধন করে বললেন, চারমাস হয় দেশ স্বাধীন হয়েছে; সরকার, তুমি মাদ্রাসা-শিক্ষার কিছু করো নাই। ব্রিটিশ সরকার এদেশের মানুষের ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল, আর বাংলাদেশ সরকার সে-ব্যবস্থা চালু রাখতে পারবে না? আমাদের ধর্মীয় শিক্ষার ভার আমাদের সরকারকেই বহন করতে হবে। কয়েকদিনের মধ্যে আবার মওলানা ভাসানী অবিলম্বে মাদ্রাসা-শিক্ষা চালু করার দাবি জানালেন এবং ন্যাপ ও সিপিবি যে ধর্ম মানে না, দেশবাসীকে তাও জানিয়ে দিলেন (এই বক্তৃতাতেই তিনি সেই বিখ্যাত উক্তি করেছিলেন : ‘মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ভারতে আমি বন্দি ছিলাম’)। শিক্ষা কমিশন গঠনের আগেই শিক্ষানীতি সম্পর্কে যে রাজনৈতিক চাপের সৃষ্টি হতে শুরু হয়েছে, এ-বিষয়ে সংশয়ের অবকাশ রইল না।
মে মাসের মাঝামাঝি সংবাদপত্র থেকে জানা গেল যে, সরকার শিক্ষা কমিশন গঠন করেছে। ড. মুহাম্মদ কুদরাত-এ-খুদা তার সভাপতি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ড. সুরাত আলী খান সহ সভাপতি এবং অধ্যাপক কবীর চৌধুরী সদস্য-সচিব। আর কোনো সদস্যের নাম প্রকাশ করা হয়নি। লোকপরম্পরায় শুনছি, আমিও একজন সদস্য, কিন্তু আমার কিছু জানা নেই। বোঝা যায়, শিক্ষা কমিশন নিয়ে সরকারের মধ্যে টানাপোড়েন চলছে এবং ওই সংক্ষিপ্ত সংবাদ প্রকাশের পরে কমিশনে ছাত্র-প্রতিনিধি নেওয়ার দাবি প্রবল হওয়ায়, অনুমান করা যায় যে, এই বিষয়টি রয়েছে টানাপোড়েনের মূলে। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ শিক্ষা কমিশন গঠনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এলো ১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই। কমিশনের গঠন নিম্নরূপ :
সভাপতি : ড. মুহাম্মদ কুদরাত-এ-খুদা; সহ-সভাপতি : ড. সুরাত আলী খান; সদস্য-সচিব : অধ্যাপক কবীর চৌধুরী; পূর্ণকালীন সদস্য : অধ্যাপক এম ইউ আহমদ (অবসরপ্রাপ্ত সদস্য, পূর্ব পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশন) ও জনাব মাহমুদ মোকাররম হোসেন (অধ্যক্ষ, কে বি এম কলেজ, দিনাজপুর); খণ্ডকালীন সদস্য : জনাব আব্দুর রাজ্জাক (অধ্যক্ষ, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়); অধ্যাপক ফজলুল হালিম চৌধুরী (অধ্যক্ষ, ফলিত রসায়ন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়); ড. আবদুল হক (গণপরিষদ সদস্য এবং প্রাক্তন অধ্যক্ষ, আইন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়); ড. আনিসুজ্জামান (অধ্যক্ষ, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়); ড. স্বদেশরঞ্জন বসু (গবেষণা পরিচালক, বাংলাদেশ উন্নয়ন-অর্থনীতি ইনসটিটিউট, ঢাকা); ডা. নূরুল ইসলাম (পরিচালক, স্নাতকোত্তর চিকিৎসা ইনসটিটিউট, ঢাকা); ড. এম শামসুল ইসলাম (অধ্যক্ষ, কৃষি অর্থনীতি বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ); ড. আ মু জহুরুল হক (অধ্যক্ষ, তড়িৎ প্রকৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল ও কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়); অধ্যাপক সিরাজুল হক (অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়); শ্ৰীমতী বাসন্তী গুহঠাকুরতা (প্রধান শিক্ষয়িত্রী, মনিজা রহমান বালিকা বিদ্যালয়, ঢাকা); অধ্যাপক মোহাম্মদ আবু সুফিয়ান (অধ্যক্ষ, চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ); ড. মযহারুল ইসলাম (মহাপরিচালক, বাংলা একাডেমি); ড. আবদুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দীন (পরিচালক, শিক্ষা-সম্প্রসারণ কেন্দ্র, ঢাকা); ড. মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ (অধ্যক্ষ, বাণিজ্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়); শ্রীমতী হেনা দাস (প্রধান শিক্ষয়িত্রী, নারায়ণগঞ্জ বালিকা বিদ্যালয়), জনাব আশরাফউদ্দীন খান (সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি)।
কমিশন তো গঠিত হলো, কিন্তু এর কাজ আর শুরু হয় না। অথচ ছ মাসের মধ্যে প্রাথমিক রিপোর্ট এবং এক বছরের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট দেওয়ার কথা। শোনা গেল, প্রধানমন্ত্রী কমিশন উদ্ববাধন করবেন, কিন্তু তিনি সময় করে উঠতে পারছেন না। মনে হলো, যে-টানাপোড়েনের কথা আগে ভেবেছি, সে-কারণেই বোধহয় অগ্রসর হওয়া যাচ্ছে না। কমিশনে ছাত্র-প্রতিনিধি গ্রহণের অব্যাহত দাবির মুখে শিক্ষামন্ত্রী একদিন ঘোষণা করলেন যে, শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট ছাত্রসমাজের কাছে গ্রহণযোগ্য না হলে সরকার তা অনুমোদন করবে না। গ্রহণযোগ্য হওয়া না-হওয়ার যৌক্তিক ভিত্তির কথা কেউ মুখে আনলেন না।