সংবিধান-রচনার প্রথম পর্যায় থেকেই সকল রাজনৈতিক দলের এবং অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তির প্রস্তাব, পরামর্শ বা মতামত চাওয়া হয়েছিল, পাওয়াও গিয়েছিল। কমিউনিস্ট পার্টি এবং ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি লিখিত প্রস্তাব দিয়েছিল এবং তা নিয়ে তার নেতাদের সঙ্গে কামাল আলাপও করেছিলেন। বিচার বিভাগের অংশটা প্রধান বিচারপতি আবুসাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে দেখানো হয়েছিল। আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগ নিয়ে একটি সুপ্রিম কোর্ট-গঠনের ধারণা তার ভালো লাগেনি; তিনি চেয়েছিলেন, হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্ট আলাদা থাকবে। বাংলা ভাষ্যে জাস্টিস শব্দের বাংলা করা হয়েছিল বিচারপতি, কিন্তু যেখানে সুপ্রিম কোর্টের জাজ বলা হয়েছে, সেখানে আমরা বিচারক করেছিলাম। বিচারপতি সায়েম চাইলেন, বাংলায় উভয় ক্ষেত্রেই বিচারপতি শব্দের প্রয়োগ করা হোক। আমি তাকে বললাম, জাজ ও জাস্টিস শব্দের পার্থক্যরক্ষার খাতিরে যথাক্রমে বিচারক ও বিচারপতি করা হয়েছে এবং সে-পার্থক্য থাকা দরকার। তিনি বললেন, হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের বিচারকেরা সর্বত্র বিচারপতি বলে। পরিচিত, তুমি তাদের মর্যাদা কমাতে চাও? আমি আর তর্ক করিনি, তবে তাঁর কথা মেনেও নিইনি। কিন্তু তার অপ্রসন্নতা দূর হয়নি। বহুকাল পরেও তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘আমি তোমাকে ক্ষমা করবো না, তুমি বিচারপতিকে বিচারক করে দিয়েছে।’ তার সঙ্গে আমাদের দূরসম্পর্কের একটা আত্মীয়তাসূত্র ছিল, তিনি আমাকে আবাল্য দেখে আসছেন, সুতরাং আমাকে তিরস্কার করার অধিকার তাঁর ছিল। সৈয়দ ইশতিয়াক আহমদ এবং আরো কারো কারো সঙ্গেও সংবিধানের খসড়া নিয়ে কামাল হোসেন আলাপ করেছিলেন।
সংবিধান-প্রণয়ন কমিটির সদস্য নন, মন্ত্রিসভার এমন সদস্যদের সঙ্গেও সংবিধানের খসড়া নিয়ে একদিন বৈঠক হয়েছিল। তাতে মহম্মদ আতাউল গনী ওসমানী উপস্থিত ছিলেন, তিনি তখন মন্ত্রী। ৪৮ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব ও কর্তব্য যেখানে নির্দেশ করা হয়েছে, সেখানে তিনি যোগ করার প্রস্তাব দিলেন যে, রাষ্ট্রপতি সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তাকে কমিশন করবেন অর্থাৎ কর্মভার দেবেন। কামালের এতে প্রবল আপত্তি। তিনি বললেন, এটি রাষ্ট্রপতির নিত্যনৈমিত্তিক নির্বাহী দায়িত্বের অন্তর্গত এবং তা সংবিধানে লিপিবদ্ধ হওয়ার মতো বিষয় হতে পারে না। ওসমানী খুব ভাবাবিষ্ট হয়ে পড়লেন, ইংরেজিতে বললেন, রাজার স্বাক্ষরিত একটা পার্চমেন্টই তো একজন সেনা কর্মকর্তার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি–এটার প্রেরণায়ই সে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দিতে যায়। আমাদের দেশেও তো রাষ্ট্রপ্রধান এই কাজটি করেন, ভবিষ্যতেও করবেন। সংবিধানে তা লিখতে আপত্তি কেন? দেশের জন্যে যারা প্রাণ দিতে প্রস্তুত, ওতে তাদের মর্যাদা একটু বৃদ্ধি পাবে মাত্র। পরে কারো কাছ থেকে সমর্থন না পেয়ে ওসমানী চুপ করে গেলেন। এক সময়ে হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘প্রফেসর, আপনি সশস্ত্রবাহিনী, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী এসব শব্দ ব্যবহার করেছেন, বাহিনী ছাড়া ফোর্সেস বোঝাতে আর কোনো বাংলা শব্দ নেই?’ আমি একটু বিচলিতই হলাম। বললাম, এগুলো বাংলায় বহুব্যবহৃত শব্দ–এর বিকল্পের কথা ভাবিনি।’ এবার উনি আসল কথাটি বললেন, ‘লালবাহিনী নীলবাহিনী শুনতে শুনতে এখন কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে। এদের যদি বাহিনী বলা হয়, তবে আর্মড ফোর্সেসকে সশস্ত্রবাহিনী বললে তাদের অপমান করা হবে।’ লালবাহিনী ছিল শ্রমিকদের নিয়ে গঠিত আওয়ামী লীগের একটি সংগঠন–অঙ্গসংগঠন ঠিক নয়, কিন্তু তার নেতা আবদুল মান্নানের প্রচণ্ড দাপট ছিল। গণপরিষদের অধিবেশন শুরু হওয়ার আগে তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, এক লক্ষ সদস্য নিয়ে লালবাহিনী গড়ে তোলা হবে। লালবাহিনী তখনই এখানে-ওখানে অন্যায় কর্তৃত্ব ফলাতে শুরু করেছিল।
সংবিধানের যে-মূল কপিতে গণপরিষদের সদস্যেরা স্বাক্ষরদান করবেন, কামাল চেয়েছিলেন, তা বাংলা হস্তাক্ষরে লিখিত হবে এবং দেশীয় ধাচে অলংকৃত হবে। হাতে লেখার জন্যে আমি এ কে এম আবদুর রউফের নাম প্রস্তাব করলাম। রউফ এক সময়ে লন্ডনে গিয়েছিলেন প্রশিক্ষণ নিতে, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি দেশের কাজে লেগে পড়েন, স্বাধীনতালাভের পরে লন্ডনে আমাদের হাই কমিশনে কর্মরত ছিলেন। তাঁকে সেখান থেকে আনাতে হবে। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন, অলংকরণের দায়িত্ব জয়নুল আবেদিন নেবেন। কামাল বললেন, রউফের বিষয়টি আবেদিন সাহেবকে জিজ্ঞেস করে নিলে ভালো হয়। বঙ্গবন্ধুর ডাকে এক সকালে জয়নুল আবেদিন এলেন প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে। তার সঙ্গে হাশেম খান, জুনাবুল ইসলাম, সমরজিৎ রায়চৌধুরী, আবুল বারক আলভী প্রমুখ কয়েকজন শিল্পী ছিলেন। তিনি বললেন, পুস্তানিতে নকশি কাঁথার অলংকরণ থাকবে, শিল্পীরা প্রতি পৃষ্ঠার চারপাশ অলংকৃত করে দেবেন। রউফের নাম তিনি অনুমোদন করলেন, ওই অলংকৃত পাতার মধ্যে তার হস্তাক্ষরে সংবিধানের পাঠ লিখিত হবে। পরে তাই হয়েছিল। অলংকরণ করেছিলেন হাশেম খান, জুনাবুল ইসলাম, সমরজিৎ রায়চৌধুরী ও আবুল বারক আলভী। রউফ বহু পরিশ্রম করে পুরো সংবিধান হাতে লিখেছিলেন। তাঁর লেখা প্রতি পৃষ্ঠা আমি দেখে দিয়েছিলাম, একটা বর্ণলোপের জন্যে তাঁকে গোটা পাতা নতুন করে লিখতে হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত এই হাতে-লেখা কপিতে সদস্যেরা (সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও মানবেন্দ্রনারায়ণ লারমা ছাড়া–এ-প্রসঙ্গে পরে বলব) স্বাক্ষর করেছিলেন এবং বি জি প্রেসে তার পাঁচ শ কপি ছাপিয়ে চামড়ার বাঁধাই করা হয়েছিল। চর্মশিল্পের কাজ করেছিলেন শাহ সৈয়দ আবু শফি। তিনি বেবীর দূরসম্পর্কের মামা, চামড়ার কাজ শিখেছিলেন শ্রীনিকেতনে। চর্মশিল্পী হিসেবে তাকে আবিষ্কার করেছিলেন হামিদা হোসেন–দারিদ্র্য ও দুর্ভাগ্যপীড়িত জীবনে তিনি যতটুকু কর্মসংস্থান ও সম্মানলাভ করতে পেরেছিলেন, তাও সম্ভবপর হয়েছিল হামিদার জন্যে।
৮.
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজাবার কথা চলছে। ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবক, সরকারি নীতিনির্ধারক–সকলেই চাইছেন, এ-ক্ষেত্রে একটা দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হোক। সেই যে জানুয়ারি মাসে শিক্ষামন্ত্রীর দপ্তরে একটা সভা হয়েছিল আমাদের কয়েকজনকে নিয়ে, তখনই কথা হয়েছিল, যতশীঘ্ৰসম্ভব একটা শিক্ষা কমিশন গঠন করা হবে। কিন্তু তা আর হয়ে উঠছে। না। শিক্ষাসচিব ড. এ আর মল্লিক কয়েক সপ্তাহ কাজ করে ভারতে আমাদের হাই কমিশনার নিযুক্ত হয়ে দিল্লি চলে গেলেন মার্চ মাসে (ইন্দিরা গান্ধির বাংলাদেশ সফরকালে তিনি ঢাকায় এসেছিলেন), নতুন সচিব হলেন এ এন এম ইউসুফ। শিক্ষা কমিশনের বিষয়ে সরকারের উচ্চবাচ্য নেই। ওদিকে ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগ দাবি করেছে, শিক্ষা কমিশনে ছাত্র-প্রতিনিধি থাকতে হবে। শোনা যায়, সরকার এ-দাবি মানতে পারছে না, আবার ছাত্রসমাজকে অসন্তুষ্ট করেও কমিশন-গঠনের ঘোষণা দিতে পারছে না।