১২ অনুচ্ছেদের বিধান নিয়ে শাসনতন্ত্র কমিটিতে বেশ বিতর্ক হয়েছিল। চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদীর সম্পাদক মোহাম্মদ খালেদ এবং আরো দু-একজন সদস্য কথাটা উঠিয়েছিলেন। তারা বেশ জোরের সঙ্গেই বলেছিলেন যে, মুসলমান হিসেবে তারা এক অখণ্ড জীবনবিধানের অধীন–সেখানে ধর্ম ও রাজনীতিকে পৃথক করা চলে না, তাদের রাজনৈতিক জীবনও ধর্মবিশ্বাস দ্বারা। পরিচালিত। তার অর্থ অবশ্য এই নয় যে, বাংলাদেশকে তারা ধর্মীয় রাষ্ট্ররূপে দেখতে চান। বাংলাদেশে পালিত ধর্মের মধ্যে রাষ্ট্র কোনো পক্ষপাত করুক কিংবা ধর্মীয় কারণে নাগরিকদের মধ্যে কোনো বৈষম্য ঘটুক, তা তাঁদের অভিপ্রায় নয়। কিন্তু রাষ্ট্রীয় বিষয়ে–যেমন, আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে–তাঁরা ধর্মীয় অনুশাসন দ্বারাই পরিচালিত হতে চান। শেষ পর্যন্ত অবশ্য অধিকাংশের মত তারা মেনে নিয়েছিলেন।
তর্ক প্রবল হয়েছিল রাষ্ট্রায়ত্তকরণের প্রশ্নে। এতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আছাদুজ্জামান খান। ৪২ অনুচ্ছেদে ক্ষতিপূরণ দিয়ে বা না দিয়ে রাষ্ট্রের পক্ষে সম্পত্তি অধিগ্রহণের বিধান করা হয়েছিল এবং সেই বিধানের আওতায় প্রণীত আইনে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা নেই বলে বা ক্ষতিপূরণ অপর্যাপ্ত হয়েছে বলে তেমন আইনের বিরুদ্ধে আদালতে প্রশ্ন তোলার সুযোগ বন্ধ করা হয়েছিল। এ-বিষয়ে যারা আপত্তি তুলেছিলেন, তাঁরা বলেছিলেন যে, বিনা ক্ষতিপূরণে সম্পত্তির অধিগ্রহণ মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী; তাছাড়া নামমাত্র ক্ষতিপূরণ দিয়ে রাষ্ট্র যদি সম্পত্তি অধিগ্রহণ করে, তাহলে সম্পত্তির মালিকের আদালতে সুবিচার প্রার্থনা করার অধিকারও থাকা দরকার–এই অধিকারও তার মৌলিক অধিকার বলে বিবেচিত হওয়ার যোগ্য। এ ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের মত মেনে না নিয়ে কমিটিতে তারা ভিন্নমতপোষক লিখিত মন্তব্য দিয়েছিলেন কার্যবিবরণীর অন্তর্ভুক্ত করার জন্যে। পরবর্তীকালে, মনে হয়, কামাল বঙ্গবন্ধুকে দিয়ে এসব সদস্যকে বুঝিয়ে ভিন্নমত প্রকাশ করা থেকে তাঁদের বিরত করেছিলেন।
সংবিধান-রচনার কাজে সাহায্য হবে মনে করে বিচারপতি এফ কে এম মুনীমকে আইন-সচিব নিযুক্ত করা হয়েছিল। তিনি মনে করেছিলেন যে, প্রজাতন্ত্রের কর্মবিভাগ অংশে যেসব বিধান করা হচ্ছে, তাতে উচ্চমেধাসম্পন্ন ব্যক্তিরা প্রজাতন্ত্রের কর্মে যোগ দিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে এবং পাকিস্তানে সিভিল সার্ভিসের সদস্যেরা যেমন জ্যোতির্ময় ছিলেন, আমাদের সিভিল সার্ভিস সে-তুলনায় হীনপ্রভ হয়ে পড়বে। কামাল তাঁকে বলেছিলেন যে, উচ্চমেধাসম্পন্নেরা সিভিল সার্ভিসে যোগ না দিয়ে পেশাগত জীবনে গেলে দেশ বেশি উপকৃত হবে।
কামাল খসড়া তৈরি করে যাচ্ছিলেন আর আমরা অনুবাদ করে যাচ্ছিলাম। মাঝে মাঝে বাংলা ভাষ্যের প্রয়োজনে কামাল তার ইংরেজি বাক্য বা তার বিন্যাস পরিবর্তন করতেন। নেয়ামালের পটুত্ব খুব কাজে এসেছিল। শব্দের উদ্ভাবনে তার নৈপুণ্য ছিল। ওমবুড়সম্যানের প্রতিশব্দ ন্যায়পাল তারই তৈরি। তবে তার মধ্যে এক ধরনের রক্ষণশীলতা ছিল। যেমন, ইংরেজিতে বহুবচন থাকলে বাংলায় সে বহুবচনই ব্যবহার করবে; মূলে যদি পার্লামেন্টারি অ্যাফেয়ার্স থাকে, তাহলে অনুবাদে সে সংসদ-বিষয়াবলি করবে, কিছুতেই সংসদ-বিষয়ক করতে রাজি হবে না। সে বারবার বলতো, দেখো, এক জায়গায় গিয়ে তুমি হয়তো দেখবে, বাংলায়ও বহুবচন ব্যবহার না করে উপায় নেই, তখন কী হবে? ইংরেজির বহুবচন বাংলায় কোথাও একবচন করবো, আবার কোথাও বহুবচন করবো, এতে সংগতি থাকে না। তবে সংবিধানে সে আরো বাংলা পারিভাষিক শব্দ ব্যবহারের পক্ষপাতী ছিল, আমিও ছিলাম। কিন্তু শাসনতন্ত্র কমিটিতে আমি সেগুলোর অনুমোদন নিতে ব্যর্থ হয়েছিলাম। শাসনতন্ত্রের বদলে সংবিধান শব্দটা গ্রহণ করাতেই আমাকে বেগ পেতে হয়েছিল। তা যখন গৃহীত হলো, তখন কমিটিও পরিচিত হলো সংবিধান প্রণয়ন কমিটি বলে। স্পিকারের প্রতিশব্দ হিসেবে কেউ অধ্যক্ষ মেনে নিতে চাইলেন না। একজন বললেন, ওতে মফস্বল কলেজের অধ্যক্ষ মনে হয়। তিনি নিজেই মফস্বল কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন, তুমুল হাস্যরোল আর করতালির মধ্য দিয়ে তার কথা প্রায় সকলেই অনুমোদন করেছিলেন। সংবিধান গৃহীত হওয়ার পরে এর ভাষার আলোচনায় আবুল মনসুর আহমদ ইত্তেফাঁকে লিখেছিলেন, পার্লামেন্টারি ডিমোক্রেসির কনসেপ্টটাই পাশ্চাত্যের, তাই ইংরেজি পরিভাষা ব্যবহার করলে দোষ হতো না, বরঞ্চ জাতীয় সংসদ না বলে পার্লামেন্ট কিংবা রাষ্ট্রপতি না বলে প্রেসিডেন্ট বলাই আমাদের উচিত ছিল। আমরা যতদূর পারি, একই ইংরেজি শব্দের জন্যে একই বাংলা শব্দ ব্যবহার করার চেষ্টা করেছিলাম। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিপ্রেক্ষিত-অনুযায়ী অবশ্য ভিন্ন শব্দ প্রয়োগ করতে বাধ্য হয়েছিলাম।
কামাল হোসেন এক পর্যায়ে স্থির করলেন, তার ইংরেজি খসড়ার চূড়ান্ত রূপদানের জন্যে একজন পেশাদার আইনি খসড়া-প্রণেতার-ইংরেজিতে যাকে legislative draftsman বলা হয়, তেমন একজনের–সাহায্য নেওয়া প্রয়োজন। দেশে তেমন কেউ ছিলেন না। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের প্রাইভেট মেম্বারস বিল তৈরি করতো একটি আইনি প্রতিষ্ঠান। তার এক সদস্যকে এই কাজে নিযুক্ত করা হলো কমনওয়েলথ সচিবালয়ের সৌজন্যে। রবার্ট গাথরি ছিলেন একজন আইরিশ আইনজীবী। ভালো মানুষ এবং স্বভাবত পরিশ্রমী। তবে আমাদের দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে তেমন ধারণা তার ছিল না। বঙ্গবন্ধুর পরামর্শ শুনে কামাল যখন ৩৮ অনুচ্ছেদের সঙ্গে একটা শর্ত জুড়ে দিলেন, তখন গাথরি আমাকে বললেন, ‘ইট’স স্টিফলিং দি অপপাজিশন’। পাকিস্তান-আমলে ধর্মের রাজনৈতিক অপব্যবহার সম্পর্কে আমি তাঁকে অবহিত করলাম, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ধর্মের নামে কেমন সব অত্যাচার হয়েছে, তাও জানালাম, কিন্তু তাতে তাঁর মনের দ্বিধা কাটেনি। তবে যেহেতু তাঁকে একটা বিশেষ পেশাগত কাজ করতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, সে-কাজটি তিনি যত্নের সঙ্গেই করে গেলেন। বাংলা পাঠের গুরুত্ব সম্পর্কে তিনি অবহিত ছিলেন। তাই তিনি আমাকে একাধিকবার বলেছিলেন যে, ইংরেজি ভাষ্যের বাংলা রূপান্তরে অসুবিধে হলে আমি যেন তাঁকে জানাই, তিনি তা পুনর্লিখন করে দেবেন। এক-আধবার তেমন। করেও দিয়েছিলেন।