তার আগে একুশে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় এসেছিলাম। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম একুশে ফেব্রুয়ারি। বাংলা একাডেমিতে বিকেলে যে-সভা হলো, তাতে নির্ধারিত কর্মসূচির বাইরেই বক্তৃতা করলেন এম এ জি ওসমানী, কে এম সফিউল্লাহ, জিয়াউর রহমান, খালেদ মোশাররফ, মীর শওকত আলী, সি আর দত্ত প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা-কর্মকর্তা। জনসাধারণের তুমুল হর্ষধ্বনি আর স্বতঃস্ফূর্ত আবেগের প্রকাশে মনে হচ্ছিল, আমরা সবাই এক হয়ে গেছি, এক হয়ে আছি, এক হয়েই থাকবো।
৭.
ড. কামাল হোসেন এত্তেলা পাঠালেন : বাংলাদেশের সংবিধান-রচনার কাজ শুরু হতে যাচ্ছে। তিনি খসড়া তৈরি করবেন ইংরেজিতে, আমাকে তার বাংলা করে দিতে হবে, শেষ পর্যন্ত বাংলাটাই গৃহীত হবে প্রামাণ্য ভাষ্য বলে। বললাম, একা পারবো না, একটা দল চাই। তিনি বললেন, আপনি লোক বেছে নিন।
প্রথমেই যার কথা আমার মনে হয়েছিল, সে নেয়ামাল বাসির। সে আমার আবাল্য বন্ধু, বাংলা-উর্দু-ফারসিতে তার অগাধ অধিকার, পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে সে ছিল দোভাষী, ওই পরিষদের দপ্তর ঢাকায় চলে আসার পরে হয়েছে সহকারী বিতর্ক-সম্পাদক। ভাষাজ্ঞানের সঙ্গে সংসদীয় বিষয়ে তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা সংবিধান-রচনায় কাজে আসবে। নেয়ামালকে প্রস্তাবটা দিতেই সে রাজি হয়ে গেল। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আর কাকে সঙ্গে পাওয়া যায়? সে তার এক সহকর্মীর কথা বললো, ভদ্রলোকের নাম বোধহয় এ কে এম শামসুদ্দীন। স্থির হলো, আমরা তিনজনে মিলে কাজটা করবো।
মনে পড়ে, আইনমন্ত্রীর দপ্তরে এক দুপুরে কামাল আর আমি মুখোমুখি বসে। প্যাডের কাগজে খসখস করে কামাল লিখতে শুরু করলেন সংবিধানের প্রস্তাবনা! এক স্লিপ লেখা হলে সাদা কাগজের সঙ্গে সেটা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। আমি অনুবাদ করতে শুরু করলাম। একটা অনাস্বাদিত শিহরণ জাগলো দেহে-মনে : এই আমার স্বাধীন দেশ, তার সংবিধান-রচনার কাজে হাত দিয়েছি।
কামালকে বললাম, অনুবাদটা মাজাঘষা করতে হবে, বাড়ি নিয়ে যাই। তিনি বললেন, মূলটারও কিছু উন্নতি ঘটাতে হবে, কাল আবার বসবো একসঙ্গে।
১০ এপ্রিল গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন বসলো। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে যারা জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাঁরা সবাই এর সদস্য। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ শহীদ হয়েছেন; পাকিস্তানের সঙ্গে সহযোগিতার অভিযোগে জহিরুদ্দীন, ফয়জুল হক, ওবায়দুল্লাহ মজুমদার, এস বি জামানের মতো কয়েকজন দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন–তাঁরা আর সদস্য নন গণপরিষদের। তাও চার শতাধিক সদস্য। গণপরিষদের অধিবেশনের শুরুতেই কয়েকটি কমিটি গঠিত হলো, তার মধ্যে শাসনতন্ত্র কমিটি’ একটি। আইন ও সংসদীয় বিষয়ক মন্ত্রী কামাল হোসেন তার সভাপতি, আর সদস্য ৩৩ জন। তারা হলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, খন্দকার মোশতাক আহমাদ, এ এইচ এম কামারুজ্জামান, আব্দুর রহিম, আবদুর রউফ, মোহাম্মদ লুতফর রহমান, আবদুল মমিন তালুকদার, আবু সাইয়িদ, মোহাম্মদ বয়তুল্লাহ, আমীরউল ইসলাম, বাদল রশীদ, খোন্দকার আবদুল হাফিজ, নূরুল ইসলাম মনজুর, শওকত আলী খান, হুমায়ূন খালিদ, আছাদুজ্জমান খান, এ কে মোশারাফ হোসেন আকন্দ, আবদুল মমিন, শামসুদ্দীন মোল্লা, আবদুর রহমান, ফকির শাহাবুদ্দীন আহমদ, আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরী, খোরশেদ আলম, সিরাজুল হক, দেওয়ান আবুল আব্বাছ, হাফেজ হাবীবুর রহমান, আবদুর রশীদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, নূরুল ইছলাম চৌধুরী, মোহাম্মদ খালেদ, রাজিয়া বাণু ও ডা. ক্ষিতীশচন্দ্র মণ্ডল। রাজিয়া বাণু ছিলেন একমাত্র মহিলা সদস্য, আর সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ছিলেন বিরোধী দলীয় একমাত্র সদস্য–তিনি তখন ছিলেন মোজাফফর আহমদের নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে। শাসনতন্ত্র কমিটির প্রথম বৈঠক হয়েছিল ১৭ এপ্রিলে।
সংবিধানের কাজে এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতি মাসে পনেরো দিন আমি ঢাকায় থেকেছি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছুটি নিয়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাশে পুরো সময়টাই কাটিয়েছি ঢাকায়। এক-আধবার ছাড়া সড়কপথে নিজেই গাড়ি চালিয়ে সপরিবারে আসা-যাওয়া করেছি। গণপরিষদ-ভবনে–পরে যা রূপান্তরিত হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে–আমাকে একটা কক্ষ বরাদ্দ করা হয়েছিল, সেখানেই সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কেটেছে। কখনো বেশি রাত হয়ে গেলে কামালের বাড়ির বসার ঘরে শুয়ে বাকি রাত যাপন করেছি, সকালে সে বাড়িতেই নাশতা করে দ্রুত চলে এসেছি গণপরিষদে।
কমিটির বৈঠকে কামালের ইংরেজি ভাষ্য এবং আমাদের অনুবাদ গণপরিষদের সচিবালয়ের মারফত বি জি প্রেস থেকে মুদ্রিত হয়ে উপস্থাপিত হতো। কমিটির সদস্য না হয়েও আমি প্রতি বৈঠকে উপস্থিত থেকেছি, অনেক সদস্যের উপস্থিতির হার তুলনায় অনেক কম ছিল। মন্ত্রীদের মধ্যে খন্দকার মোশতাক আহমাদ ও এইচ এম কামারুজ্জামান খুব কমই আসতেন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদ আসতেন মাঝে মাঝে। তাজউদ্দীন যেদিন আসতেন, সেদিন আলোচনায় যোগ দিতেন সাগ্রহে। কোনো কমিটিতেই সব সদস্য অংশ নেন না–এটিও তার ব্যতিক্রম ছিল না।
সংবিধানের বিষয়ে পরামর্শ দিতে বঙ্গবন্ধু দুবার ডেকে পাঠিয়েছিলেন কামালকে–সঙ্গে আমিও ছিলাম। তাঁর প্রথম বক্তব্য ছিল রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের সংযোগ ছিন্ন করার একটা বিধান থাকতে হবে সংবিধানে। ১২ অনুচ্ছেদে এ বিষয়ে কিছুটা বলা হয়েছিল, তবে বঙ্গবন্ধু যা চেয়েছিলেন, তা সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদের শর্ত অংশে রূপ পেয়েছিল। দ্বিতীয়বারে তিনি বলেছিলেন, পাকিস্তান-আমলে সরকার অস্থিতিশীল হয়েছিল মূলত পরিষদ-সদস্যদের দলবদলের ফলে কিংবা দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে দলের বিপক্ষে ভোটদানের ফলে। এটা বন্ধ করা দরকার। নির্বাচিত সদস্য যদি দলের কোনো সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত না হন কিংবা কোনো ক্ষেত্রে দলের বিরুদ্ধে ভোট দেন, তাহলে তার পদত্যাগ করা উচিত হবে কিংবা তার সদস্যপদ চলে যাবে–এমন একটা নিয়ম করা দরকার। তবে এমন ক্ষেত্রে তিনি উপনির্বাচনে বা পরবর্তী কোনো নির্বাচনে প্রার্থী হবার অযোগ্য হবেন না, সে-ব্যবস্থাও থাকতে হবে। এই অভিপ্রায়ই সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে প্রকাশ পেয়েছিল।