ভয়ে আতঙ্কে ঘুম হারাম হলো।
স্ত্রী অবশেষে ডাক্তারের শরণাপন্ন হল। কিন্তু ডাক্তারের কথা শুনে কান্না করতে-করতে বাড়ি ফিরল। হ্যাঁ, ঠিকই আছে, পেটের ভেতরের জিনিসটা দিন-দিন বড় হচ্ছে। সময়ে আরও বড় হবে। তারপর, একদিন আলোর মুখ দেখবে সেটা। ধীরে ধীরে পরিণত হবে। এরপর, একদিন হয়তো বংশধরও সৃষ্টি করবে–“মা হতে চলেছে লুইসা!”
স্বামীর অনুভূতি কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন হল। একরকম অদ্ভুত আনন্দ হল তার। ক্লাবে গিয়ে বন্ধুদের কাছে খুব গর্ব করে বেড়ালো। তবে স্ত্রীর কান্না যেন থামতেই চায় নাঃ নিজেকে নিয়ে ভীষণ দুঃশ্চিন্তা হল, এখন তার অবস্থান নীচু হয়ে যাবে যে! কিছুদিন পর থেকেই তো আর উপার্জন করতে পারবে না। তখন যে তাকে স্বামীর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে হবে! তাছাড়া, কাজ করতে পারবে না বলে কাজের লোকও তো রাখতে হবে। অর্থাৎ, কাজের লোকের ওপরও এরকম নির্ভরশীলতা আসবে। “উফ! এত দিনের সমস্ত চিন্তা-চেতনা, ধ্যানধারণা এভাবে ধ্বংস হয়ে যাবে?”
ওদিকে, খবর পাওয়ার পর থেকে অনবরত মায়ের চিঠি আসতে লাগলো। প্রতিটি চিঠিতে তিনি ঘুরেফিরে একই কথা ববাঝাতে চেষ্টা করেন–“বিয়ে হচ্ছে ঈশ্বরের আশীর্বাদ, সন্তান প্রতিপালনে সেটা পূর্ণতা পায়। পিতা-মাতার নিজেদের সুখ এখানে বিশেষ ধর্তব্য নয়।” হুগোও (স্বামী) বারবার অনুরোধ করতে থাকল, স্ত্রী যেন আয়-উপার্জনের ব্যাপারে কখনো মন ছোট করে না থাকে। শিশুর দেখাশোনার জন্য সে যা করবে তা কি কাজ নয়? একে কি টাকা দিয়ে মূল্যায়ন করা সম্ভব, না উচিত? টাকা-পয়সাতো কাজের মাধ্যমেই আসে। তাহলে কি এ-সংসারে তার অবদানকে কোনভাবে খাটো করা যায়? কখনোই না; বরং আগের মত তারা সমানে-সমানই থাকবে।
তারপরও স্বামীর ওপর নির্ভরশীলতার কথাটা লুইসা কোনওভাবেই মানতে পারছিল না। কিন্তু কোল আলো করে আসা শিশুর কান্না কানে যাওয়ামাত্র অন্য সব কিছুই সে ভুলে গেল।
*** *** ***
আগের মত ‘স্ত্রী’ আর ‘বন্ধু’ দুই পরিচয়েই রইলো লুইসা। সেইসাথে একটা নতুন পরিচয় যোগ হল–সে এখন সন্তানের মা! হুগোর কাছে মনে হল, শেষের পরিচয়টিই সবচেয়ে বেশি মূল্যবান!
প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা
বাবা তাকে বুক-কিপিং এর কাজটা শিখে রাখতে বলেছিলেন, যাতে আর দশটা মেয়ের মত স্বামী-সংসারের প্রতীক্ষায় বসে থাকতে না হয়। এখন সে রেলওয়ে অধিদপ্তরের মালামাল বিভাগে বুক-কিপারের কাজ করে। অফিসের সবাই তাকে একজন যোগ্য কর্মী এবং যোগ্য নারী হিসেবে চেনে। সবার সাথেই সে চমৎকারভাবে মিশতে পারে। সব মিলিয়ে, তার মধ্যে অমিত সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে।
একদিন বন বিভাগের এক কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ হল। অল্প কিছুদিনেই দুজনের মধ্যে বেশ বোঝাপড়া হয়ে গেল। কিছুদিন বাদে তারা বিয়ে করল। নতুন দম্পতির চিন্তাভাবনা সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির সিদ্ধান্ত হল, তারা কখনোই সন্তান নেবে না। বিয়ে হচ্ছে একটা আত্মিক বন্ধন; এখানে সন্তান খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। জগৎকে তারা দেখিয়ে দিতে চায়, নারী মানেই ভোগের বস্তু নয়–নারীরও মন আছে।
স্বামী-স্ত্রীর দেখা হয় রাতের বেলা খাবার টেবিলে। নানা আদর্শিক কথাবার্তা হয় তখন। তাদের বিয়েটা তো দুটো আদর্শের মিলন, দুটো আত্মার মিলন। এ মিলনের মধ্যে আদর্শিক কথাবার্তা থাকবে সেটাইতো স্বাভাবিক, তাই না? যাহোক, দেহের মিলনও কদাচিৎ ঘটে, তবে সে ব্যাপারে নিজেদের মধ্যে কখনো কোন কথা হয় না।
স্ত্রী একদিন বাড়ি ফিরে জানালো তার অফিসের সময়সূচি পরিবর্তিত হয়েছে। পরিচালক মহোদয় সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এখন থেকে রাতের বেলা মার্লমো পর্যন্ত একটা নতুন ট্রেন চালু হবে। সুতরাং সন্ধ্যে ছ’টা থেকে নটা পর্যন্ত অফিসে থাকতে হবে। স্বামীর জন্য এটা খুবই বিরক্তিকর একটা ব্যাপার হল। কারণ সে নিজে কিছুতেই ছটার আগে বাড়ি ফিরতে পারে না, আর এখন বাড়ি ফিরে দেখতে হবে বউ বাড়িতে নেই। কী আর করা! ‘ভাগ্যের লিখন না যায় খণ্ডন’–এখন আর একসাথে বসে খাওয়া হয় না, রাতের বেলা অল্প একটু সময়ের জন্য দেখা হয়। স্বামী বেচারার দুঃখের সীমা নেই। সন্ধ্যাবেলার দীর্ঘ সময়টাকে সে এখন রীতিমত ঘৃণা করে।
ধীরে ধীরে অভ্যাসে কিছুটা পরিবর্তন এল। সন্ধ্যাবেলায় সে স্ত্রীর অফিসে গিয়ে বসে থাকে। কিন্তু মালামাল বিভাগে বসে থাকাটা মোটেই সুখকর কোন অভিজ্ঞতা নয়, বিশেষত আসতে যেতে কুলিরা যখন ধাক্কা দিয়ে চলে যায়, তখনতো নয়ই। কীভাবে যেন প্রতিবার সে কুলিদের হাঁটাচলার পথের ওপরেই বসে পরে! যাহোক, এতসব ঝক্কি সামলে স্ত্রীর সাথে একটু আলাপ করার চেষ্টা করামাত্র সে কাঠখোট্টাভাবে বলে ওঠে “ওফ! কাজ শেষ না-হওয়া পর্যন্ত বিরক্ত কর না।” ধমক খেয়ে বেচারা একেবারে চুপ মেরে যায়, আর লক্ষ করে কুলিরা মুখ ফিরিয়ে হাসছে। কখনোবা স্ত্রীর সহকর্মীদের বলতে শোনা যায়–“মিসেস অমুক, আপনার স্বামী আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।” ‘স্বামী’ শব্দটা ওরা এমনভাবে উচ্চারণ করে যে শুনলেই গা জ্বালা করে। তবে, সবচেয়ে বেশি বিরক্ত লাগে স্ত্রীর পাশের টেবিলের আহাম্মকটাকে দেখলে। গর্দভটা সবসময় স্ত্রীর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে; আর, নানা ছুতোয় গপ্পো জমানোর চেষ্টা করে। জমা-খরচের খাতা দেখানোর ছল করে এমনভাবে কাঁধের ওপর দিয়ে ঝুঁকে পরে কথা বলে যে একটু হলেই ওর চিবুক তার স্ত্রীর গায়ে লেগে যায়। স্ত্রী অবশ্য এতে কিছু মনে করে বলে মনে হয় না। চালানবই, নথিপত্র ইত্যাদি বিষয় নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে গর্দভটার কথোপকথন শুনলে মনে হয় যেন এসব ব্যাপারে সবকিছু তার নখদর্পণে! দুজনকে আলোচনারত অবস্থায়। দেখলে বোঝা যায়, ওরা একে অপরকে বেশ ভালোভাবে জানে; এতটা ভালোভাবে যে, হয়ত স্বামী-স্ত্রী নিজেরাও নিজেদের অতটা ভালোভাবে জানে না। অবশ্য সেটা অযৌক্তিকও নয়; কারণ, স্বামীর সাথে স্ত্রী যতটা সময় কাটায়, তার চেয়ে অনেক বেশি সময় কাটায় ঐ আহাম্মকটার সাথে । তাই, কিছুদিন পর থেকে স্বামীর মনে হতে লাগল–তাদের বিয়েটা আসলে সত্যিকারের আত্মিক বন্ধন নয়, সেটা হত যদি সে নিজেও মালামাল বিভাগে কাজ করত। আফসোস! সে তো কাজ করে বন বিভাগে।