“আমাকে সু……র দেখাচ্ছে?” থেমে থেমে শব্দটা উচ্চারণ করলেন স্ত্রী।
“হুম! একটু-আধটু কাজ করাটা বোধহয় তোমার জন্য ভালোই।” স্বামীর সপ্রশংস মন্তব্য।
তবে এর ফল কিন্তু হল উল্টো।
–“একটু-আধটু? একে তোমার একটু-আধটু কাজ মনে হয়েছে? তা কতটুকু হলে তোমার কাছে বেশি কাজ মনে হবে, শুনি?” স্ত্রীর চোখ-মুখ দিয়ে যেন ঝাঁজ বেরুচ্ছে।
স্বামী বেচারা ঘাবড়ে গেলেন–“দেখ, আমি কিন্তু সে রকম কিছু বলিনি। তোমাকে কষ্ট দেয়ার কোন ইচ্ছাই আমার নেই।”
“অবশ্যই আছে” আগের মতই রেগে আছেন স্ত্রী। “তুমি স্পষ্ট বোঝাতে চেয়েছ, গতকাল আমি যথেষ্ট কাজ করিনি! অথচ ভুলে গেছ, সবার আগে আমি তোমার রুমটাই পরিষ্কার করেছি। মানে, আমি বোধহয় কাজের লোক হলেই ভালো হত, না? সারাদিন কাজ করতাম, রান্না। করতাম, ঘর গোছাতাম। তাহলে নিশ্চয়ই তুমি খুশি হতে। তুমি অস্বীকার। করতে পার আমি তোমার দাসী নই?”
স্বামী এ অবস্থাকে আর দীর্ঘায়িত হতে দিলেন না। চুপচাপ রুম থেকে চলে এলেন। বাইরে যাবার সময় কাজের লোককে বেশ শাসিয়ে গেলেন “এখন থেকে সকাল সাতটায় উঠে আমার রুম পরিষ্কার করবি। ম্যাডামকে যেন আর তোর কাজ করতে না হয়।”
সন্ধ্যাবেলা ব্ল্যাকউড সাহেব বেশ খোশমেজাজে ঘরে ফিরলেন। স্ত্রী কিন্তু তখনো রেগে ছিলেন। আমাকে তোমার রুম পরিষ্কার করতে দেয়া হল না কেন?” থমথমে গলায় জিজ্ঞেস করলেন।
–কারণ ‘তুমি আমার দাসী’, এই অভিযোগ আমি মানতে পারি না।–কেন মানতে পার না?
–আমি ওভাবে কখনো চিন্তাও করিনি। ওভাবে চিন্তা করতে আমার কষ্ট হয়।
–ও আচ্ছা, এই কথা! কিন্তু আমাকে দিয়ে রান্নাবান্না করাতে, ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা করাতে কষ্ট হয় না?”
স্বামী এ-প্রশ্নের কোন উত্তর দিলেন না। স্ত্রীর মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে, অন্যরুমে চলে গেলেন। পরদিন ট্রামে করে অফিসে যাবার পথে, পুরো সময়টা তিনি এইসব ব্যাপারে গভীরভাবে চিন্তা করলেন। সন্ধ্যায় যখন বাড়ি ফিরলেন, ততক্ষণে তাঁর বেশ গোছালো চিন্তাভাবনা হয়ে গেছে। এবার স্ত্রীকে নিয়ে বসলেন তিনি–“শোন ডার্লিং, বাড়িতে তোমার অবস্থান নিয়ে খুব গুছিয়ে একটা চিন্তা করেছি। তবে তার ফল কিন্তু তুমি যা বলেছিলে তার পুরোপুরি বিপরীত দাঁড়িয়েছে। কোনভাবেই আমার মনে হয়নি, তুমি এ বাড়ির কাজের লোক বা আমার দাসী। কিন্তু তবুও, তোমার যেহেতু মনে হয়েছে, আমরা একটা মধ্যবর্তী কোন উপায় বের করতে পারি। আমার মতে সবচেয়ে ভালো বুদ্ধি হচ্ছে, এখন থেকে তুমি নিজেকে বোর্ডিং হাউসের মালিক বলে মনে করবে, আর আমি বোর্ডার হিসেবে মাসে-মাসে তোমাকে ভাড়া দেব। অর্থাৎ, কী তুমিই থাকলে। আমি যে বোর্ডিংয়ে খাওয়াদাওয়া করছি, সেই বাবদ খরচও তোমার কাছেই দেব।”
স্ত্রী কেমন হকচকিয়ে গেলেন–“কী বলতে চাইছ?”
–বললামতো, খুব সহজ! আমরা এখন থেকে মালিক আর ভাড়াটিয়া হলাম। তবে ব্যাপারটা আমরা শুধু মনে মনেই রাখবো, আমাদের সম্পর্কে এর কোন প্রভাব পড়বে না।
–আচ্ছা বেশ! তা তুমি আমাকে কী পরিমাণ ভাড়া দেবে?
–সেই পরিমাণ, যে পরিমাণ দিলে আমাকে তোমার কাছে ঋণী থাকতে না হয়! আশা করি, এতে আমার নিজের অবস্থানেরও উন্নতি হবে। কারণ তখন আমার আর মনে হবে না, আমি কারও দয়ার ওপর বেঁচে আছি!
–দয়ার ওপর?
“নয়তো কী? তুমি আমাকে খেতে দিচ্ছ আধাসিদ্ধ খাবার; অথচ, বলে বেড়াচ্ছ–তুমি আমার চাকরানি, আমার জন্য কাজ করতে করতে তুমি মরে যাচ্ছ!” কথাগুলো বলার সময় স্বামীকে বেশ আত্মবিশ্বাসী দেখালো।
“তুমি আসলে ঠিক কী বোঝাতে চাইছ, বলতো?”
–তেমন বিশেষ কিছু না। শুধু বলছি, বোর্ডার হিসেবে দিনে ত্রিশ ডলার দিলে চলবে তো? অন্য যেকোন বোর্ডিং হাউস কিন্তু বিশ ডলারেই রাজি হবে।
–চলবে, ত্রিশ ডলারেই চলবে।
“বেশ, তাহলে মাসে দাঁড়াচ্ছে প্রায় হাজার ডলার। আর আমি প্রথম মাসের টাকাটা অগ্রিম দিচ্ছি–এই নাও এক হাজার ডলার।” পকেট থেকে একটা হাজার ডলারের নোট আর কাগজ-কলম বের করলেন ব্ল্যাকউড সাহেব। স্ত্রীর হাতে নোটটা গুঁজে দিয়ে, সংসারের পুরো মাসের খরচ একটা বিল আকারে লিখলেন। বিলটা এরকম
ভাড়া–৫০০ ডলার
নার্সের বেতন–১০০ ডলার
রাধুনির বেতন–১৫০ ডলার
স্ত্রীর ভরণপোষণ–৫০০ ডলার
স্ত্রীর হাত-খরচ–৫০০ ডলার
নার্সের আনুষঙ্গিক খরচ–৩০০ ডলার
রাধুনির আনুষঙ্গিক খরচ–৩০০ ডলার
ছেলেমেয়েদের ভরণপোষণ–৭০০ ডলার
ছেলেমেয়েদের জামাকাপড়–৫০০ ডলার
জ্বালানি, কাঠ, অন্যান্য–৫০০ ডলার
সর্বমোট–৪০৫০ ডলার
এবার স্ত্রীকে বললেন, “সংসার যেহেতু দুজনেরই, অতএব এই ৪০৫০ কে ২ দিয়ে ভাগ কর। কত হল? ২০২৫ ডলার। অর্থাৎ, আমাদের যার-যার ভাগে পড়ল ২০২৫ ডলার করে। তাহলে তোমাকে কিছুক্ষণ আগে যে ১০০০ ডলার দিলাম, সেটা তোমার ভাগের ২০২৫ ডলার থেকে কেটে রেখে, বাকি ১০২৫ ডলার আমাকে ফেরত দাও!”
স্ত্রী মনে হল সব গুলিয়ে ফেলেছেন। কোনমতে আমতা-আমতা করে বললেন, “ইয়ে মানে, তুমি কী চাচ্ছ যে, আমি এখন তোমাকে টাকা দেব?”
“অবশ্যই, যেহেতু আমরা সমান-সমান, অতএব ব্যাপারটাতো তা-ই দাঁড়াচ্ছে। সেক্ষেত্রে, তোমার আর সন্তানদের খরচের শুধু অর্ধেকটা আমার বহন করার কথা, তাই না? নিয়মতো তা-ই বলে।” খুব যত্ন করে গুছিয়ে কথাগুলো বললেন স্বামী। তাঁর কথা তখনো শেষ হয়নি, “নিয়ম ভঙ্গ করে পুরো খরচ আমি একাই দেব এমনটা নিশ্চয়ই তুমি আশা কর না? কারণ, সেক্ষেত্রে তো আমাকে ৪০৫০ ডলার ছাড়াও বোর্ডিং ভাড়া বাবদ অতিরিক্ত ১০০০ ডলার তোমাকে দিতে হবে। কিন্তু আমি তো আমার ভাগের ২০২৫ ডলারের বাইরেও শুধু ভাড়া বাবদ ১০০০ ডলার তোমাকে দিচ্ছিই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই ২০২৫ ডলারের বিনিময়ে আমি কী পাচ্ছি? পাচ্ছি, অতি উপাদেয়(!) খাবারদাবার। শুধু এই অতি-উপাদেয়(!) খাবারের জন্য নিশ্চয়ই আমাকে পুরো ৪০৫০ ডলার দিতে হবে না?