শিবাজি তার ক্রোধপ্রকাশের অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই আগ্রা থেকে তার ৯ বছরের ছেলে শম্ভুজিকে নিয়ে পালিয়ে যান। খুব সম্ভবত, বের হওয়ার জন্য প্রহরীদের ঘুষ দিয়েছিলেন শিবাজি। তবে কাল্পনিক অনেক কাহিনীতে বলা হয় যে ব্রাহ্মণদের দান করার জন্য আনা বিশাল বিশাল ঝুড়িতে করে পালিয়ে গিয়েছিলেন শিবাজি। মোগল ভূখণ্ড থেকে বের হওয়ার আগে পর্যন্ত ভ্রাম্যমাণ সন্ন্যাসীর বেশ গ্রহণ করেছিলেন তিনি। এক ইতিহাসবিদ বলেছেন, তার ছেলেও একই পোশাক গ্রহণ করেছিলেন। তবে একটি বর্ণনায় দেখা যায়, ভ্রমণের সময় যাতে তাকে চেনা না যায়, সেজন্য তিনি ব্রাহ্মণের স্ত্রীর ছদ্মবেশ গ্রহণ করেছিলেন। কয়েক বছর আগে সমর্পণ করা দুর্গগুলো পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে শিবাজি ১৬৬৯ সালে নতুন করে হামলা চালানোর মাধ্যমে মোগল কর্তৃত্ব অস্বীকার করার কথা ঘোষণা করেন ।
শিবাজির সাথে সম্পর্ক যে কারণেই নষ্ট হয়ে থাকুক না কেন, মোদ্দা কথা হলো, আওরঙ্গজেব তাকে মোগল পতাকার নিচে সামিল করতে পারেননি। আপাত দৃষ্টিতে এই ব্যর্থতাকে ধাঁধা মনে হতে পারে। কারণ, রাজপুতেরা কয়েক প্রজন্ম ধরেই মোগল আভিজাত্যে একীভূত হওয়ার ক্ষেত্রে ইতিবাচকভাবে সাড়া দিচ্ছিল। অবশ্য, এই উদাহরণ সব হিন্দু সম্মিলিতভাবে গুরুত্বপূর্ণ মতপার্থক্যগুলো দেখতে তথা আওরঙ্গজেবের আনুষ্ঠানিক অভ্যর্থনায় শিবাজি কেন বেঁকে বসলেন, তার ব্যাখ্যা করতে বাধা দেয়। ওই সময়ের অনেক রাজপুত শিবাজিকে মনে করত অসভ্য ভুঁইফোড়, মোগল পরিভাষায় যার আদবে ঘাটিত ছিল। বস্তুত বেশির ভাগ রাজপুতের তুলনায় ফারসি দরবারি আদব কায়দায় পিছিয়ে ছিলেন শিবাজি। তার বাবা বিজাপুরের আদিল শাহি রাজবংশের অভিজাত হলেও তিনি শৈশব কাটিয়েছিলেন তার মা জিজাবাইয়ের কাছে। সেখানে দরবারি জীবন ছিল অনুপস্থিত। সম্ভবত এই অবস্থার কারণে (এ দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে তার দক্ষতাকে অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে না) শিবাজির পক্ষে মোগল অভিজাত হিসেবে তার ভূমিকায় মানিয়ে নিতে পারেননি, যেমনটা পেরেছিলেন অনেক রাজপুত। শিবাজি বরং আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রেই অবতীর্ণ হওয়াকেই গ্রহণ করে নিয়েছিলেন ।
—
শিবাজির বিদ্রোহে প্রত্যাবর্তন মোগলদের জন্য বিপর্যয়কর হয়েছিল। ১৬৭০ থেকে শিবাজি সুরাত ও অন্যান্য স্থান বারবার লুটপাট করেন। পরের চার বছর তিনি মহারাষ্ট্রে খানদেশ, বেরার ও বেগলানের মতো মোগল ঘাঁটিগুলোতে অভিযান পরিচালনা করেন, মোগল ও বিজাপুরি উভয় বাহিনীর বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হন। এই সময়ে আওরঙ্গজেব সাম্রাজ্যের উত্তর-পশ্চিম পাবর্ত্য এলাকায় পাঠান গোত্রগুলোর বিদ্রোহ দমনে নিয়োজিত ছিলেন।
আওরঙ্গজেব ১৬৭৪ সালের জুনে ব্যক্তিগতভাবে যখন খাইবার পাসের কাছে পার্বত্য এলাকায় আফ্রিদি গোত্রের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, তখন শিবাজি নিজেকে রাজা তথা ছত্রপতি ঘোষণা করেন। তার এই স্বাধীন মারাঠা রাজ্য ওয়েস্টার্ন ঘাট ও কোনকান উপকূলের অংশবিশেষজুড়ে বিস্তৃত ছিল। শিবাজি পরের ছয় বছর ব্যয় করেন মারাঠা এলাকা সম্প্রসারণে । তিনি সংস্কৃতভিত্তিক রাজনৈতিক রীতিনীতির মাধ্যমে ইন্দো-ফারসি আদব কায়দার পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৬৭৭ সালে তিনি রাজাবিবাহারকোষ (রাজকীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর শব্দকোষ) নামে পরিচিত একটি সংস্কৃত গ্রন্থের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। এতে ১৫০০ ইন্দো-ফারসি প্রশাসনিক পরিভাষার সংস্কৃত প্রতিশব্দ স্থান পেয়েছিল। এ ধরনের গ্রন্থ গবেষণাসুলভ মনে হলেও এটি মোগল শাসক সংস্কৃতি দমনে তার প্রয়াস সফল করতে সহায়ক হয়েছিল। শিবাজির শাসনকালের শেষ দিকে মারাঠা সরকারি নথিপত্রে সংস্কৃত পরিভাষা ব্যাপকভাবে বেড়ে ছিল ।
শিবাজি ১৬৭৮ সাল থেকে একের পর এক রোগে আক্রান্ত হতে থাকেন । দুই বছর পর ১৬৮০ সালে তিনি বিছানায় পরলোকগমন করেন। শিবাজির মৃত্যু নিয়ে অনেক গুজব প্রচলিত রয়েছে। এর একটি হলো তার দ্বিতীয় স্ত্রী সূর্যবাই তাকে বিষ প্রয়োগ করেছিলেন শম্ভুজির বদলে তার ১০ বছর বয়স্ক ছেলে রাজারামকে সিংহাসনে বসানোর জন্য। শম্ভুজি ছিলেন তার বাবার প্রথম স্ত্রীর সন্তান। বিষ প্রয়োগের কাহিনী সম্ভবত সত্য নয়। তবে রাজারাম ও শম্ভুজির মধ্যে সংক্ষিপ্ত উত্তরাধিকার লড়াই হয়েছিল। এতে শম্ভুজি জয়ী হয়ে বাবার উত্তরসূরি হিসেবে দাক্ষিণাত্যে মোগল স্বার্থের বিরুদ্ধে উৎপাত অব্যাহত রেখেছিলেন ।
—
শিবাজি ও আওরঙ্গজেব যদিও মাত্র একবার মুখোমুখি হয়েছিলেন (১৬৬৬ সালে দরবারে) তারা একে অপরকে তাচ্ছিল্য করতেন। শিবজির অন্যতম রাজকবি ভূষণ সম্রাট আওরঙ্গজেবকে কুম্ভকর্ণ হিসেবে অভিহিত করেছেন। রামায়ণে এই নামে একটি বিপুলাকায়, অতিভোজী দানব চরিত্র আছে। আওরঙ্গজেব ‘পার্বত্য মুষিক’ বলতেন শিবাজিকে। মোগল সূত্রগুলো গালিগালাজ করে তাকে বলত শিব, সম্মানসূচক জি কখনো যোগ করা হতো না। আওরঙ্গজেবের আমলের অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকের এক ইতিহাসবিদ শিবাজির মৃত্যুর তারিখটি লিপিবদ্ধ করেছেন বেশ রূঢ়ভাবে : ‘কাফিরটি দোজখে গেল।’ (কাফির বিজাহান্নাম রাফত)।
মোগল-মারাঠা সঙ্ঘাত দানা বেঁধেছিল কৌশলগত, পরিবর্তনশীল মিত্ৰতা দাবিকারি পাশবিক শক্তি লাভের আকাঙ্ক্ষা থেকে । শিবাজি বিজাপুর, গোলকোন্ডা এবং প্রয়োজনীয় সময়ে মোগলসহ (অনেক ক্ষেত্রে দক্ষিণ ভারতে হিন্দু শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে) অনেক ইসলামি রাষ্ট্রের সাথে মিত্রতা করেছেন। শিবাজি তার সেনাবাহিনীতে মুসলিমদের স্বাগত জানাতেন; তার বেতনভুক কাজি (মুসলিম বিচারক) ছিল, তার শীর্ষ কমান্ডারদের মধ্যে কয়েকজন ছিলেন মুসলিম। মোগল মিত্রতা ও রাজকীয় বাহিনীও ছিল বৈচিত্র্যময়। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, পুরান্দারে শিবাজিকে অবরোধ করার জন্য আওরঙ্গজেব পাঠিয়েছিলেন জয় সিং নামের এক হিন্দুকে। রাজপুত ও মোগল শাসনের বিরোধিতাকারী মারাঠারা নিজেদেরকে ‘মুসলিম’ স্বৈরতন্ত্র প্রতিরোধকারী ‘হিন্দু’ হিসেবে পরিচয় দানের আধুনিক ধারণাটি নিছকই আধুনিক কালের। মোগল বা মারাঠা কোনো পক্ষের লেখকেরাই (বিশেষ করে মারাঠারা) এই সঙ্ঘাতকে ধর্মীয় যুদ্ধের আবহে আখ্যায়িত করতে কোনোভাবেই কুণ্ঠিত ছিলেন না। তবে বাস্তবে রাজনৈতিক ক্ষমতার তৃষ্ণা থেকেই আওরঙ্গজেবের শাসনের বিরোধিতা ও মোগল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল।
৫. নীতিপরায়ণ মানব ও নেতা
ধর্মভক্তি ও ক্ষমতা
সম্রাট [আওরঙ্গজেব] একটি দোয়া লিখে সেটিকে [বন্যার] পানিতে নিক্ষেপ করলেন। সাথে সাথেই পানি কমতে শুরু করল। খোদাভক্ত সম্রাটের দোয়া খোদা কবুল করলেন, দুনিয়া আবারো শান্ত হলো ।
–ভীমসেন স্যাক্সেনা, আওরঙ্গজেব বাহিনীর এক হিন্দু সৈনিক, লিখেছেন ফারসিতে