নয়ন ব্যাপারীর কথায় কোনো উত্তর করে না জমিরুদ্দিন চাচা। একমনে নিজের কাজ করে যাচ্ছে। নয়ন ব্যাপারী আবার বললো, ‘মসজিদ বানাইবো মহল্লার মাইনষে মিইল্লা। তুমি একাই মসজিদ বানাইবা কিল্লাই? এতে তোমার ফায়দা কী জমিরুদ্দিন? তার চাইতে তুমি এক্কান কাজ করো। জমিখানায় আবাদ করো। ফসল লাগাও। সবজি লাগাও। ফসলাদি বেইচা তোমার আরামেই দিন কাটবো। টুপি বেইচা আর কয় টেকাই কামাও, কও তো?’
মাথা তুলে নয়ন ব্যাপারীর দিকে তাকান জমিরুদ্দিন চাচা। তার চাহনিতে স্বপ্নে ভর করে চলার এক অদম্য স্পৃহা। স্বপ্নকে জলাঞ্জলি দেওয়ার প্রস্তাব সেই স্পৃহায় যেন আগুন ধরিয়ে দিলো। সেই আগুনের সবটুকু পারলে জমিরুদ্দিন চাচার চোখ ফুড়ে বেরিয়ে আসে। কিন্তু আসে না। চাচা ধৈর্য ধরে আর বলে, ‘ভালা কথাই কইছেন মিয়া ভাই। তয়, মসজিদ বানানের চাইতে বড় আরামের কাজ আর কী আছে কও? এইডাই তো লাভের ব্যবসা।
নয়ন ব্যাপারীর কথা হালে পানি পেলো না। মুখের ভেতরে চিবোতে থাকা পানটাকে থু মেরে দুরে নিক্ষেপ করে ব্যাপারী বললো, ‘মসজিদ আবার লাভের ব্যবসা ক্যামনে হয় মিয়া?
জমিরুদ্দিন চাচা হাসলো। স্ফীত হাসি হেসে বললো, ‘সব লাভ কি আর চোখে দেহন যায় গো মিয়া ভাই?
চাচার কথায় দমে যায় না ব্যাপারী। পুনরায় বলে, তোমার কথাবার্তা বুঝি না বাপু। তোমার ভালার লাগি কইছিলাম। পুলা মাইয়ার ভবিষ্যৎ আছে। তুমি বুড়া হইছ। নিজের সারাজীবনের সম্বল দিয়া যা-ও এক্কান জমি জুড়াইলা, সেইখানে আবার মসজিদ বান্ধনের ঝোঁক! তুমি চোখ বুজার পরে এই পোলা মাইয়াগো দেখবো কেডায় সেই কথা কুনোদিন ভাবছোনি মিয়া?’
আবারও মাথা তুলে তাকায় জমিরুদ্দিন চাচা। তার মুখে এখনো সেই মধুর স্ফীত হাসি। হাসিটা আনন্দের না তাচ্ছিল্যের বোঝা যাচ্ছে না। চাচা মুখে হাসি ধরে রেখেই বললো, ‘ব্যাপারী ভাই, আমারে যেমনে আল্লাহ দেখতাছে, আমার পোলা-মাইয়াগোরেও আল্লাহ দেখবো। হাত-পাও নিয়া যখন জন্মাইছে, আল্লাহর জমিনে তাগো জন্যি কী আর খাওনের অভাব হইব? আমার বাপে চইলা গেলো এমনে কইরা, আমিও যাই-যাই, আমার পোলাপানও চইলা যাইব, ইন শা আল্লাহ।
জমিরুদ্দিন চাচার কথাগুলো গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনলাম। বেশ নতুন কিছু কথা। এমন কথা আমার কিশোর মন এর আগে কখনোই শোনেনি। ছমিরুদ্দিন শুনেছে কি? বলতে পারছি না। জমির চাচা ওখানেই থেমে গেলে পারতেন। কিন্তু তিনি থামলেন না। বলে যেতে লাগলেন অনর্গল, ‘আল্লাহ কুরআনে কি কইছে হুনো নাই, মিয়া ভাই? আল্লাহ কইছেন, যারাই আল্লাহর ওপর ভরসা করবো, তাগো লাইগা আল্লাহ এমন জায়গা থেইকা রিজিক পাঠাইব, যা মানুষ চিন্তাও করার পারবো না। এইডাই আল্লাহর ওয়াদা। আল্লাহর ওয়াদা মিথ্যা হয়, কও? আমি আল্লাহর উপরেই ভরসা করসি। আমার সন্তানগো জন্যে আমার টুপি বেচার ব্যবসাই সই। ওই ব্যবসাতেই আমার যা আয় হয় তা দিয়াই আমি চলমু। আমার পরে আমার ছেলেমেয়ে চলবো। বেচা-বিক্রি কম হইলে কম খামু। সমস্যা নাই কোনো। কিন্তু আল্লাহর ঘর বানানির যে স্বপন দেখছি মিয়া ভাই, এই স্বপন পুরা না কইরা মইরা গেলে বড় আপসোস থাইকা যাইবো’
দমে যাবার পাত্র নয় নয়ন ব্যাপারী। জমির চাচার কথাগুলোকে পাত্তা না দিয়ে বললেন, ‘এমন বুজরুকি কথাবার্তা শুনতে ভালোই লাগে জমিরুদ্দিন। রিজিকের বন্দোবস্ত কইরা যদি খালি কথাতেই পেট ভইরতো, তাইলে তো ভালাই আছিলো। কথায় বলে, অভাব যখন দুয়ারে আইসা দাঁড়ায়, ভালোবাসা তখন জানলা দিয়া পলায়।
এবার জোরেই হেসে ফেললেন জমিরুদ্দিন চাচা। হাসতে হাসতে বললেন, ‘মিয়া ভাই, যে রিজিক আসমান থেইকা আসে, তার লাগি এতো পেরেশানি কিয়ের?
শেষ চালটা চেলেই দিলেন জমির চাচা। নয়ন ব্যাপারী আর কথা বাড়ায়নি। জমিরুদ্দিন চাচার যুক্তি এবং আবেগের কাছে নাস্তানাবুদ হয়ে ভগ্ন মনোরথে প্রস্থান করলো বাড়ির উদ্দেশ্যে। কাজে আবার ডুব দিলো জমিরুদ্দিন চাচা। ছমিরুদ্দিনও একমনে কাজ করে যাচ্ছে। মাটি খুঁড়ছে। পাতিলে ভরছে। আমিও লেগে পড়লাম তাদের সাথে! মসজিদ বানানোর কাজ। শরীক হওয়ার মধ্যেই কেমন যেন আনন্দ!
দেখতে দেখতে অল্প কয়েকদিনের মধ্যে জমির চাচার মসজিদ দাঁড়িয়ে গেলো। মাটির মসজিদ। ছনের পাতার ছাউনি। মসজিদের ভেতরে একটা মাদুর আর একটি জায়নামায। এই মসজিদে প্রতিদিন আযান হয়। আযান দেয় জমির চাচা। মুসল্লী দুজন। ওরা বাপ-বেটা। মুসল্লী কি কখনো বাড়বে? মানুষ কি দলবেঁধে কখনো আসবে এই স্বপ্নের মসজিদে সালাত পড়তে? প্রশ্নগুলোর উত্তর আসার আগেই প্রস্থানের সময় হয়ে এলো জমির চাচার। একদিন খুব ভোরে, সুবহে সাদিকের প্রাক্কালে জমিরুদ্দিন চাচা ইন্তেকাল করেন।
[দুই]
এরপর, অনেকগুলো দিন পার হলো। অনেকগুলো বছর। চাকরির উদ্দেশ্যে আমি পাড়ি জমিয়েছি বহুদূরের শ্বেতপাথরের দেশে। এই দেশে মস্ত মস্ত দালান। এখানে দিগন্তবিস্তৃত ফসলি মাঠ নেই, নেই একটু বসে জিরিয়ে নেওয়ার মতন শতবর্ষী পুরোনো কোনো বটবৃক্ষ। এখানে চাঁদ আর তারার মাঝে মিতালি নেই, সূর্যের প্রথম কিরণে গা ডুবিয়ে বসে থাকার আনন্দ নেই। এখানে ইটের ইমারতের আড়ালে ঢাকা পড়ে থাকে রাতের রুপোলি চাঁদ।