‘জমিরুদ্দিন চাচা লজেন্সের লোভ দেখিয়ে আমাদের হাটে বেচে দেবে’ –বাবার এই কথা আমার বিশ্বাস হলো না। যে লোক টুপি বেচে, যে লোকের মাথায় টুপি, মুখে লম্বা দাড়ি, সে তোক মিথ্যে কথা বলতে পারে? সে লোক ছেলেধরা হতে পারে?
এক দুপুরে, বাড়ির সকলের চোখ ফাঁকি দিয়ে আমি বেরিয়ে পড়লাম জমিরুদ্দিন চাচার বানানো মসজিদ দেখতে। আমাদের পাশাপাশি বাড়ি হলেও মাঝখানে রয়েছে একটা মৃতপ্রায় নদী। এককালের ভরা-যৌবনা নদীটা এখন তার ভগ্নাবশেষ নিয়ে কোনোমতে এখানে টিকে আছে। যদিও মৃতপ্রায় নদী, স্রোতের বালাই নেই কোনো, তবু একসিনা পানি তাতে বর্তমান থাকে সর্বদাই। সেই পানির গা জুড়ে বসতি গড়ে থাকে অসংখ্য কচুরিপানা। এই একসিনা পানি ডিঙিয়ে, কচুরিপানার আস্তরণ সরাতে সরাতে জমির চাচার মসজিদ দেখতে যাওয়ার কোনো মানে হয় না। আমি অন্যপথ ধরলাম। আধ ক্রোশ পথ ঘুরে ঠিক ঠিক পৌঁছে গেলাম জমিরুদ্দিন চাচার বাড়িতে।
বড় একটা জারুল গাছের নিচে বৃদ্ধ মানুষের শরীরের মতন জবুথবু হয়ে থাকা একটা ঘর। ঘরের দেয়াল গলে বাইরে বেরিয়ে যেতে চাইছে যেন। সামনের খুঁটিগুলো জমিরুদ্দিন চাচার জীবনের প্রতিচ্ছবির মতোই; দুঃখের ভারে নুইয়ে পড়েছে। ভীষণ বর্ষার বিপন্ন সময়ে এই ঘর কতোখানি বিপজ্জনক তা দেখামাত্রই আঁচ করতে পারা যায়। তবুও, জীবন কি থেমে থাকে? শ্বাপদসংকুল অরণ্যের মাঝ থেকে মধু সংগ্রহ করতে যাওয়া মৌয়ালেরা ভালো করেই জানে ঘন জঙ্গলের কোথাও শিকারের লোভে হাঁ করে আছে কোনো ক্ষুধার্ত বাঘ, কিংবা কোনো তরুলতার গায়ে লেপ্টে আছে বিষধর কোনো সাপ। উভয়ের মারণাঘাতে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী জেনেও তারা গহিন অরণ্যে পা বাড়ায়। কারণ, জীবনে বাঁচবার যন্ত্রণা মৃত্যুযন্ত্রণার চাইতেও মাঝে মাঝে প্রবল হয়ে ওঠে।
জমিরুদ্দিন চাচার জীর্ণ এই গৃহখানা দেখলে এমনই বিপদের সংকেত পাওয়া যায়। যেকোনো মুহূর্তে, যেকোনো ঝড়ে একটা ধ্বংসস্তূপের আগাম চিত্র যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে। অথচ এই ঘরেই চাচা জমিরুদ্দিন বাস করে যাচ্ছেন বছরের পর বছর। এখানেই তিনি টুপি বানান। এখানেই সংসার এবং হয়তো এখানেই তার জীবনের পরিসমাপ্তি।
মাথার ওপর থেকে দুপুরের সূর্য সরে হালকা পশ্চিমে চলে গেছে। এখন বিকেল। আমি দেখলাম, ছমিরুদ্দিনকে সাথে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন জমিরুদ্দিন চাচা। একজনের হাতে কোদাল আর অন্যজনের হাতে বড় একটা পাতিল। আমাকে দেখে চিনে ফেলল ছমিরুদ্দিন। বয়স তখন কতো আর হবে? তেরো বা চৌদ্দ। ছমিরুদ্দিন আমাকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকলো। আমি কাছে এলে জমিরুদ্দিন চাচা বললেন, ‘কাশেমের বাপের পোলা না তুমি?’
আমি স্মিত হেসে বললাম, ‘জে, চাচা।‘
‘মসজিদ দেখবার আইছো?’
‘হ।‘
‘মা শা আল্লাহ! মা শা আল্লাহ। ছমির, পকেটে লজেন্স আছেনি?’
‘নাই বাপজান!’, ছমির উত্তরে বললো।
‘ঘরেত্তুন দুইডা লজেন্স নিয়া আয়। তাত্তাড়ি যা। পুলাডারে দুইডা লজেন্সই দে।’
ছমির পাতিল মাটিতে রেখে লজেন্স আনতে যায়। ঘরের কপাট খুলতে গেলে ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ হলো। চোখের পলকেই ছমির লজেন্স নিয়ে ফিরে আসে। আমার হাতে লজেন্স দু-খানা পুরে দিয়ে সে বললো, ‘দুইডাই তোর।‘
সত্যি কথা হলো, লজেন্সের লোভে আমি জমির চাচার আস্তানায় হানা দিইনি। আমি এখানে এসেছি কেবল মসজিদটা দেখার জন্য। সেই মসজিদ, যার গল্প জমির চাচা সারা গ্রামময় করে বেড়ায়। তার স্বপ্ন। তার জীবনাকাঙ্ক্ষা। একদিন সেই মসজিদে একটা মিনার হবে। সেই মিনার হতে আযানের ধ্বনি ছড়িয়ে পড়বে সর্বত্র।
দুই জনের কাফেলায় আমি তৃতীয় জন হিশেবে যুক্ত হয়ে গেলাম। খুব বেশি নয়, জমিরুদ্দিন চাচার বসত-ভিটা থেকে অল্প উত্তর-দক্ষিণে গেলেই একটা উঁচু ঢিপি এলাকা। বৃষ্টি-বাদলে পানি ওঠার সম্ভাবনা নেই। এই উঁচু উর্বর জমিতে চাষ হচ্ছে একটা নতুন স্বপ্নের। জমিরুদ্দিন চাচার স্বপ্ন। স্বপ্নের নাম মসজিদ।
মসজিদের জন্য জমিরুদ্দিন চাচা যার কাছ থেকে জমি কিনেছেন তার নাম নয়ন ব্যাপারী। আমরা হাঁটতে হাঁটতে সেই উঁচু ঢিপি এলাকায় এসে দেখি গলায় গামছা ঝুলিয়ে নয়ন ব্যাপারী বসে আছে। তার ঠোঁট দুটো রক্তজবা ফুলের মতন লাল। আমাদের দেখে সে মুখ থেকে পানের পিক ফেলে জোর গলায় বললো, ‘আইছো জমিরুদ্দিন?
‘হ মিয়া ভাই।‘
‘তোমার মসজিদ কদ্দূর?’
‘এই তো, হইয়া যাইব।‘
‘কই, কিছুই তো চোখে দেহিনা।‘
জমিরুদ্দিন চাচা হাসে। হেসে বলে, ‘সময় হইলেই দেখা যাইব মিয়া ভাই। কথাগুলো বলে জমির চাচা ছমিরুদ্দিন আর আমাকে নিয়ে একটু তফাতে চলে • এলেন। বুঝতে পারলাম এটাই সেই মসজিদের জায়গা। জমিরুদ্দিন চাচা খানিকক্ষণ একদৃষ্টে জায়গাটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। অপলক। এরপর ছমিরুদ্দিনকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘কাজে লাইগা পড় বাজান।
কাজে লেগে গেলো বাপ-বেটা দুজনেই। জমিরুদ্দিন চাচা কোদাল দিয়ে মাটি সমান করে, আর উদ্বৃত্ত মাটি পাতিলে ভরে দূরে ফেলে আসে ছমিরুদ্দিন। কখনো ছমিরুদ্দিন খোঁড়ে, চাচা মাথায় বয়ে নিয়ে যায় মাটি। খানিক বাদে আবার দেখা মিললো নয়ন ব্যাপারীর। কাঁধে সেই গামছা ঝোলানো। ব্যাপারীদের বৈশিষ্ট্যই বোধকরি এ রকম। নয়ন ব্যাপারী বললো, আমি কই কি জমিরুদ্দিন, মসজিদ বানাইবার চিন্তাটা তুমি বাদ দেও।