বৃষ্টি নিয়ে আমার এমন ভাবালুতার মাঝে ছেদ ঘটালো রেবেকা। সে বেলকনিতে আমার পাশে দাঁড়িয়ে বললো, ‘কী সুন্দর বৃষ্টি, তাই না গো?
হু।
‘মানুষের দুআ যে এতো দ্রুত কবুল হয়, তা দেখে আমি তাজ্জব বনে গেলাম, জানো?’
আমি কৌতূহলী দৃষ্টিতে রেবেকার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘বুঝিনি।
‘ওই যে, গরমে তুমি বেশ হাঁসফাঁস করছিলে না? তখন রান্নাঘর থেকে মনে মনে দুআ করছিলাম। বলছিলাম, আল্লাহ, একটা ঝুম বৃষ্টি দিয়ে চারপাশটা ঠান্ডা করে দাও। আমার জামাইটার অস্বস্তি লাগছে অনেক। এমন বৃষ্টি দাও যেন আমার জামাই বৃষ্টি নিয়ে একটা গল্পও লিখে ফেলতে পারে। হি হি হি।
‘তুমি কি সত্যিই এমন দুআ করেছিলে?
‘হ্যাঁ। এমনটাই তো জপছিলাম রান্নাঘরে। কিন্তু বিশ্বাস করো, সত্যি সত্যিই যে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামবে–তা আমার ধারণাতেই ছিলো না। আল্লাহ মাঝে মাঝে কতো দ্রুত দুআ কবুল করে ফেলেন, দেখলে?
আমি জানি রেবেকা মিথ্যে বলেনি। ও কখনোই মিথ্যে বলে না। আমাদের পাঁচ বছরের দাম্পত্য জীবনে কোনোদিন একটিবারের জন্যও তাকে আমি মিথ্যে বলতে দেখিনি। ও যখন এই দুআ করেছে বললো, তাহলে সেটা অবশ্যই সত্যি।
ফ্যানের নিচে বসে হাওয়া গিলতে থাকা আমার অস্বস্তি কাটাতে বৃষ্টির জন্য দুআ করেছে জ্বলন্ত চুলোর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক রমণী! কী অবিশ্বাস্য ভালোবাসা কী অনুপম মায়ার বন্ধন!
রেবেকা আবার বললো, বৃষ্টির সময় দুআ করলে ওই দুআও কবুল হয়। চলো, আমরা দুআ করি।
‘কী দুআ করবো?
‘যা মন চায় করো।
জানালা গলে, রেবেকার হাত চলে গেলো বাইরে। রিমঝিম বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে তার হাত। আমি দেখলাম, সে চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে কিছু বলছে। আমি জানি, তার এই বলার অনেকটা জুড়ে আমি আছি। ও আমাকে রাখবেই।
[তিন]
রাত নেমে গেছে অনেক আগেই। থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে এখন। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আমি ল্যাপটপ খুলে বসে পড়লাম। কালকেই আমাকে একটা ফিচার জমা দিতে হবে অফিসে। পত্রিকার ত্রৈমাসিক ম্যাগাজিন প্রকাশের সময় আর বেশি। নেই হাতে।
অনেকটুকু লেখার পরে খেয়াল করলাম, বাইরে আবার ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। বাতাসে জানালার কাঁচগুলো রিনিঝিনি শব্দ তুলছে। আমি পড়ার ঘর থেকে শোবার ঘরে এলাম। আলো জ্বালিয়ে দেখি রেবেকা ঘুমিয়ে পড়েছে। সারাদিনের সাংসারিক ব্যস্ততার পরে এক শান্তির ঘুমে বেঘোর সে। তার নিষ্পাপ, মায়াময় চেহারা, তাতে কোথাও কোনো অভিযোগের রেখা ফুটে নেই। এই মেয়েটা সারাটা দিন আমাকে নিয়ে ভাবে। আমার ভালো থাকা, আমার ভালো-লাগা নিয়ে তার কতো ভাবনা-চিন্তা! মাঝে মাঝে মনে হয়–মেয়েরা বোধকরি অন্য ধাতুতে গড়া। একেবারে অপরিচিত একটা মানুষ, একটা পরিবার, একটা পরিবেশকে তারা কতো নিবিড়ভাবে আপন করে নেয়! কতো সুন্দর করে তাতে এঁকে দেয় ভালোবাসার আল্পনা!
বেলকনিতে এসে দাঁড়ালাম আমি। বৃষ্টির সময়ে দুআ করলে সেই দুআ কবুল হয়। বাইরে হাত বাড়াতেই বৃষ্টির ফোঁটাগুলো আমার হাতে লেগে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। চোখ বুজে, হৃদয়ের গভীর থেকে ভাষা টেনে নিয়ে, বিড়বিড় করে বললাম, ‘পরওয়ারদিগার, রেবেকাকে আমি অসম্ভব ভালোবাসি। এই দুনিয়ার মতো, জান্নাতেও আমরা এভাবে কাছাকাছি, পাশাপাশি থাকতে চাই।
০৩. আসমানের আয়োজন
[এক]
ছমিরুদ্দিন ভাই আমার প্রতিবেশী। পেশায় টুপি-বিক্রেতা। নিজের হাতে টুপি বানিয়ে বিক্রি করেন। পেশাটা মূলত পৈত্রিক সূত্রেই পাওয়া। উনার বাবা জমিরুদ্দিন সরদার হাতে-কলমে ছেলেকে এই বিদ্যে শিখিয়ে গেছেন। দিব্যি যে ব্যবসা করছেন, তা অবশ্য নয়। কোনোরকমে দিনগুজার যাকে বলে। ছমিরুদ্দিনের তাতে কোনো আফসোস নেই যদিও; তবু তার মুখে একটা কথা প্রায়ই শোনা যায়, বাপে আমাগো লাইগা এক্কান মসজিদ ছাড়া আর কিছু রাইখ্যা যায় নাই।
কথাটা মিথ্যে নয়। মানুষ সন্তানাদির জন্যে ব্যাংক-ব্যালেন্স, জায়গা-জমিসহ নানা স্থাবর-অস্থাবর সহায়-সম্পত্তি করে গেলেও জমিরুদ্দিন চাচা রেখে গেছেন কেবল একটি মাটির মসজিদ। সারাজীবন নিজের হাতে যা কামাই করেছেন, তার মধ্যে যেটুকু সঞয়াদি ছিলো, তা দিয়েই বাড়ির নিকটে জমি কিনে তাতে নিজ হাতে মাটির একটি মসজিদ তুলেছেন। জমিরুদ্দিন চাচার স্বপ্নই ছিলো এটা।
আমরা তখনো অনেক ছোটো। দেখতাম চাচা সারাদিন হেঁটে হেঁটে টুপি বেচতেন। সাথে থাকতো ছমিরুদ্দিন। আমাদের দেখলেই চাচা হাঁক ছেড়ে বলতেন, ‘ও বাজানেরা, আমি মসজিদ বানাইতেছি এক্কান। তোমরা নামায পইড়তে আইসো কিন্তু। আইলেই তোমাগো আমি লজেন্স দিমু।’
লজেন্সের লোভে আমরা চাচার মসজিদটা দেখতে যেতে চাইতাম। কিন্তু বাবা বাগড়া দিতো। বলতো, ‘জমির পাগলার কথা হুইনো না। খাইতে ভাত পায় না আবার হেতে বানাইব মসজিদ! ব্যাঙের হইছে গিয়া সর্দি-জ্বর! লজেন্সের লোভ দেখাইয়া তোমাগোরে নিয়া হাটে বেইচ্যা দিব কইলাম।’
ছেলে ধরে নিয়ে বেচে দেওয়ার একটা রটনা তখনো গ্রামাঞ্চলে মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত ছিলো। হঠাৎ হঠাৎ শোনা যেতো অমুক বাড়ির অমুকের ছেলেকে ভরদুপুরে ছেলেধরা নিয়ে গেছে। সারা তল্লাটে হইচই পড়ে যেতো। বাবা-মায়েরা আমাদের ওপর বাড়িয়ে দিতে বাড়তি নজরদারি। দুপুরের ঘুম তুলে রেখে মাঠ দাপিয়ে বেড়ানোর আমাদের যে আদিম উৎসব, সেই উৎসব চুলোয় যায় এই ছেলেধরা গুজবের তোপে। কি সকাল, কি দুপুর বা বিকেল–বাচ্চাকাচ্চারা বাইরে বেরোলেই বিপদ। ওত পেতে আছে ছেলেধরার দল। কিন্তু সেই ছেলেধরার দলকে কেউ কোনোদিন চোখের দেখা আর দেখল না। কেবল মানুষের মুখে মুখেই ছড়িয়ে পড়েছিলো তাদের খ্যাতির বাহার।