মিনু তার সেই ক্লান্ত-ভারাক্রান্ত, অসহায় চাহনি নিয়ে শহিদুলের মুখের দিকে তাকায়। আশা করে, শহিদুল হয়তো এখনই ফোঁস করে উঠবে। ভেস্তে দেবে অপবাদের সমস্ত পসরা। কিন্তু আজ! আজ শহিদুলও যেন পরাজিত। কিংবা সকলের সংঘবদ্ধ তিরস্কারের কাছে অপাঙক্তেয়। আজ পাড়া-পড়শির দিন। আজ দিনটাই শহিদুলের মায়ের। দীর্ঘ দিনের জমানো ক্লেদ, জিঘাংসা এবং রোষের সমস্তটাই যেন আজ প্রবল উৎসাহে বেরিয়ে আসতে চাইছে। জনতার যৌথ জনরোষের কাছে আজ শহিদুল মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে না। অথচ তাকেই আজ খুব বেশি দরকার মিনুর। খুব বেশি প্রয়োজন।
সে রাতে পরপর দুটো ঘটনা ঘটে গেলো। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে, শহিদুল তালাক দেয় মিনুকে এবং ওই রাতেই পাশের বাড়ির তরফদারের মেয়ের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয় শহিদুল। শোকসন্তপ্ত বাড়িটাতে শোকের আবহকে পাশ কাটিয়ে, প্রতিশোধের চরম জিঘাংসাই যেন প্রথম এবং প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়াল। আর মিনু? শাদু মিয়ার বলদ-গাড়ি তো ছিলই। ও রাতেই সে জালাল মাস্টারের ভিটে মাড়িয়ে পাড়ি জমায় দূরের পথে। তারাভরা রাত… সমস্ত পত্র-পল্লবে যেন জোছনার মেলা বসেছে। দূরে কোথাও ডাহুক ডাকছে। বুনো ফুলের গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসছে মাঝে মাঝে। থেমে থেমে শেয়ালের আওয়াজ আসছে কানে। এ সবকিছুকে ঘিরে মিনুর একরাশ মুগ্ধতা, আবার কোনো মুগ্ধতাই যেন নেই।
ঠিক এক সপ্তাহ পরে শহিদুল শহরে ফিরবে। খুব বেশি ছুটি নেই তার। নতুন বউকে এ বাড়িতেই রেখে যেতে হবে। শহিদুলের মায়ের সাথে তার গড়ে উঠেছে দারুণ সখ্য। শাশুড়ি তাকে চোখে হারায় যেন। বেরুনোর প্রস্তুতি নিতে গিয়ে শহিদুল দেখল, মিনু তার লাগেজখানা ফেলে গেছে। যা গায়ে ছিলো, ওটুকুতেই প্রস্থান করেছে মেয়েটা। শশব্যস্ত হয়ে শহিদুল লাগেজখানা খুলে বসল। লাগজের ভেতরে ছোট্ট একখানা প্যাঁচানো চিরকুট। দ্বিগুণ উৎসাহ এবং কৌতূহলী হয়ে সেটা মুখের ওপর ধরে পড়তে লাগলো শহিদুল–
‘ভাববেন না আবেগ দিয়ে আপনার কাছে নিজের ভুলের ফিরিস্তি লিখতে বসেছি। আপনার কাছে জবাবদিহির আর কোনো অধিকার কিংবা দরকার, কোনোটাই আর অবশিষ্ট নেই। কারণ, এই চিঠি যখন লিখছি, তখন আপনার সাথে আমার জাগতিক সকল সম্পর্কই ছিন্ন হয়ে গেছে। তবু, নিজের অবস্থানটা বলে যেতে না পারলে। শান্তি পাচ্ছিলাম না। একটা অপবাদ মাথায় নিয়ে এভাবে প্রস্থান করবো, তা কোনোভাবেই মানতে পারছিলাম বলেই এই লেখাটুকুর অবতারণা।
ছেলেটা আমার ছিলো। আপনারও। দুজনের। তাকে তো আমিই দীর্ঘ নয় মাস পেটে ধারণ করেছি। আমার রক্ত-মাংস চুষে সে বেড়ে উঠেছিল। আস্তে আস্তে। সে যখন অস্তিত্বে এলো, যেদিন তার আগমনের সংবাদ আমরা পেলাম, মনে পড়ে কতো বিচিত্র উল্লাসে, কতো সুখ আর স্বপ্নের মাঝে আমরা ডুব দিয়েছিলাম? আমার নাড়ি ছিঁড়ে যখন সে বেরোয়, জানেন, একটিবারের জন্য আমার মনে হয়েছিলো, বোধকরি আমি আর বাঁচব না। তখন আমার মায়ের কথা খুব মনে পড়ছিল। মায়ের মুখটা না দেখেই যদি মরে যাই, কেমন যেন একটা অতৃপ্তি রয়ে যাবে মনে। কিন্তু, পরক্ষণে যখন আমাদের সন্তানের কথা মনে এলো, যখন মনে হলো যে আমার শরীরে বেড়ে উঠছে অন্য আরেক আমি, সে বেঁচে থাকলেই আমার বেঁচে থাকা হবে, তখন মনে হলো–না! এমন মৃত্যুতে ভয় কীসের? এ যে বীরাঙ্গনার মৃত্যু!
যখন বাবুটা এলো পৃথিবীতে, আমাদের সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে? তাকে ঘিরে কতো যত্ন, কতো খেয়াল আমাদের। গভীর রাতে যখন সে কান্না করে উঠতো, আমি মুহূর্তে জেগে যেতাম। তাকে শান্ত করতে আমার সে কী কসরত! . কখনো আপনাকে ডেকে তুলিনি। জাগাইনি। বিরক্ত করিনি। আমিই সামলেছি। যখন তার আমাশয় ধরা পড়ে, একেবারে কাহিল হয়ে ওঠে সে, সেই স্মৃতিগুলো আমি কখনোই ভুলবো না।
আপনি, আপনার মা এবং আপনার আশপাশে সবার অভিযোগ, সন্তানের মৃত্যুতে কেন আমার চোখে একফোঁটা পানি নেই। প্রশ্নটা নিজের প্রতি আমারও। পরে মনে হলো, ওর জন্য যা কাঁদার, তা তো আমি জায়নামাযেই কেঁদেছি। আর কোনো জল যে আমার চক্ষু-কোটরে অবশিষ্ট নেই। কোত্থেকে আসবে?
আমি কাঁদিনি। বিলাপ করিনি। বুক চাপড়াইনি। কেবল পাথর হয়ে ছিলাম। আমার এরূপ কাণ্ডকারখানা দেখে আপনাদের মনে অনেক প্রশ্ন দানা বেঁধেছে, অনেক কৌতূহল জেগে উঠেছে, অনেক সন্দেহ ঘনীভূত হয়েছে। আপনাদের প্রশ্নোন্মুখ চেহারা, কৌতূহলোদ্দীপক অভিমূর্তি আমাকে কাঁদাতে পারেনি। কেন জানেন? অনেকদিন আগে আমি একটি হাদিস জেনেছিলাম। সম্ভবত এমন দিনের জন্যই ওটা আমার চোখে পড়েছিলো এবং আমি ব্যাপক আগ্রহ নিয়ে সেটা পড়েছিলাম সেদিন। হাদিসটি শুনুন–
যখন আল্লাহর কোনো বান্দার সন্তান মারা যায়, তখন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা ফেরেশতাদের বলেন, তোমরা কি আমার বান্দার সন্তানের জান কবজ করে ফেললে?’
ফেরেশতারা বলে, ‘জি।
তখন আল্লাহ আবার বলেন, ‘তোমরা আমার বান্দার প্রাণ-কণাটাকে ছিনিয়ে আনলে?’
ফেরেশতারা আবার বলে, ‘জি।
আল্লাহ বলেন, তখন আমার বান্দা কেমন আচরণ করেছে?
ফেরেশতারা বলে, আপনার বান্দা ধৈর্য ধরেছে আর বলেছে, নিশ্চয় আমরা আল্লাহর কাছ থেকেই এসেছি এবং তার কাছেই পুনরায় ফিরে যাবো।