লোকটা আমার কথায় বেশ আগ্রহ দেখিয়ে বললেন, ‘কেমন স্মৃতি, একটু বলা যাবে প্লিজ?’
নিজের একান্ত ব্যক্তিগত স্মৃতির ব্যাপারে অন্য কারও আগ্রহ আমার জন্য রীতিমতো পীড়াদায়ক। তবে, আমার কৈশোরের সেই স্মৃতিটার সাথে এই লোকটার নামের যেহেতু কাকতালীয় একটা মিল আছেই, তাই তার সামনে সেই স্মৃতির কিছু অংশ রোমন্থন করতে মন চাইলো।
‘আসলে, হাইস্কুলে আমাদের ক্লাসে এক ছাত্র ছিলো আলাদিন নামে। পড়াশোনায় খুব বেশি ভালো সে কখনোই ছিলো না। তবে সে খুবই ভদ্র আর নিরীহ গোছের ছিলো। চেহারায় হাবাগোবা একটা ভাব, কথাবার্তায় অপটু আর নিতান্ত শান্ত স্বভাবের কারণে তাকে আমরা ‘হাবাগোবা আলাদিন’ নামে ডাকতাম। তার কিছু স্মৃতি আজকাল আমাকে ভীষণভাবে ভাবায়। আমাদের সেই আলাদিন কতো অল্প বয়সে, কতো নিবিড়ভাবেই না জীবনকে বুঝতে শিখেছিল। অথচ তাকে আমরা কখনোই পাত্তা দিতাম না। লাস্ট বেঞ্চের ছাত্র জ্ঞান করে সব সময় উত্ত্যক্ত করতাম। জানি না আজ সে কোথায়। জীবনের পাঠোদ্ধারে সে আর কোন মহাসমুদ্র পাড়ি দিয়েছে তাও বলতে পারি না। তবে এটা জানি–আমরা যারা একসময় তাকে উপহাস করেছিলাম, তারা একটা কুয়ো থেকে একটা পুকুরে এসে পড়েছি কেবল। সমুদ্র দেখার সৌভাগ্য আমাদের আর হলো কই?’
কথাগুলো বলতে গিয়ে আমার কণ্ঠসূর বারবার আড়ষ্ট হয়ে পড়ছিল। হৃদয়কে আচ্ছন্ন করে ফেলছিল এক গভীর আবেগ। সে আবেগ যতোখানি না আলাদিনের জন্যে, তারচেয়ে বেশি তার সেই জীবনদর্শনের জন্যে, যার দিকে একসময় প্রফুল্লচিত্তে সে আমাদের আহ্বান করতো।
তিনি কথা বললেন এবার, ‘সেই কুলটার নাম কি সাদনপুর আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়?’
আমার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা শীতল পানির স্রোত যেন নিচে নেমে গেলো। চমকাবারও একটা সীমা থাকে, কিন্তু এবেলায় আমি সেই সীমা-পরিসীমা ছাড়িয়ে গেলাম যেন। চোখেমুখে বিপুল বিস্ময় ধরে রেখে আমি বললাম, ‘ঠিক তাই। কিন্তু আপনি কীভাবে জানলেন?’
হেসে ফেললেন লোকটা। তার ঠোঁটের কোনায় সেই মুক্তো-ঝরা হাসি যেন অনেক রহস্যের জট খুলে দেয়। আমার বিস্ময়ের পারদকে মহাশূন্যে তুলে দিয়ে তিনি বললেন, ‘আমিই সেই হাবাগোবা আলাদিন।’
বজ্রাহত মানুষের মতো স্থির হয়ে গেলো আমার দৃষ্টি। আমাদের সেই আলাদিন আমার সামনে বসে আছে–এ যেন এক অবিশ্বাস্য বাস্তবতা! আমার গলার আওয়াজ কোথায় যেন লুপ্ত হয়ে গেলো। নিজেকে কোনোরকমে সামলে নিয়ে বললাম, ‘তু-তুমি সত্যিই আমাদের সেই আলাদিন?
‘তুমি রূপম, তাই না?’
‘কীভাবে বুঝলে?’
‘শুনেছিলাম আমাদের ওই স্কুলের এক ছাত্রের বেশ নামডাক হয়েছে। দুনিয়াজোড়া খ্যাতি পেয়েছে। আর তা ছাড়া তোমার চেহারাও তেমন পাল্টায়নি। আগের মতোই আছে। এই চেয়ারে তোমাকে দেখে এবং স্কুলের কথা উঠে আসাতে মনে হলো যে, তুমি ছাড়া আর কে হতে পারে?’
‘তুমি আমার চেহারাও মনে রেখেছো, আলাদিন?’
হেসে ফেলল সে। তার দেখাদেখি আমিও হাসতে লাগলাম। আমার মনে পড়ে যায় সেই কৈশোরের গল্প! সেই স্কুল, সেই ক্লাসরুম, সেই বন্ধুদের। কতো স্মৃতি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে সাদনপুর আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠের ধুলোয়, কাঠের বেঞ্চে।
আমি জিগেশ করলাম, ‘এটা তোমার মেয়ে?’
‘হ্যাঁ।’
হিজাব-আবৃতা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আমি বললাম, ‘বাপকি বেটি হয়েছিস। বেঁচে থাক মা।’
[পাঁচ]
আলাদিনের সাথে আমার অনেক আলাপ হয়ে গেছে। আমাদের সেই বিজ্ঞান স্যারের গল্প, অঙ্ক স্যার যে তাকে ‘মুদি দোকানদার’ বলে ডাকতো সেই গল্প, ডাকাবুকো মুনতাসিরের গল্প-সহ আমার বিদেশ-বিভুইয়ের হরেক পদের গল্প। বাদ যায়নি আমার উচ্ছন্নে যাওয়া ছেলেটার গল্পও। নিয়তির কী নির্মম পরিহাস! নামের সাথে জগৎ-জোড়া খ্যাতির ডিগ্রি থাকার পরেও আজ আমি একপ্রকার ব্যর্থ, আর নিতান্ত সাধারণ জীবনযাপনের আলাদিন আজ আমার সামনে একজন সফল পিতা হিশেবে দণ্ডায়মান!
আমি আলাদিনের হাত ধরে বললাম, ‘চলো আমরা আবার আমাদের সেই কৈশোরে ফিরে যাই। সেই সাদনপুর স্কুলে। টিফিন পিরিয়ড শেষে তুমি রোজ দেরি করে ক্লাসে আসবে আর বিজ্ঞান স্যার বিনা বাক্য-ব্যয়ে রোজকার মতো তোমাকে ছেড়ে দেবে। আযান হলে তুমি এসে আমাদের বলবে, ‘যুহরের আযান হচ্ছে। আমার সাথে মসজিদে যাবে? এই যে দেখো, মুয়াজ্জিন বলছে, ‘হাইয়্যা আলাল ফালাহ।’ মানে হলো–সফলতার পথে এসো। জীবনে সফল হতে চাইলে চলো আমরা সালাতে যাই।’
যদি সত্যিই ফিরে যেতে পারি জীবনের সেই দিনগুলোতে, সত্যি বলছি আলাদিন, সফলতার পথে তোমার সেই উদাত্ত আহ্বানগুলো আর কোনোদিন উপহাসে ফিরিয়ে দেবো না।