মেয়েটা এবার আগের চাইতে আরও স্পষ্ট, আরও গোছানো গলায় বললো, ‘আমাকে ক্ষমা করবেন স্যার। আপনার শিক্ষকসুলভ দরদ আমি বুঝতে পারছি; কিন্তু আমার ধর্মকে যেখানে ছোটো করে দেখা হয়, সেখানকার সাফল্যে সাফল্যমণ্ডিত হওয়ার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। আমার ধর্মপালনের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিয়ে যদি কোনোদিন আমার ক্যাম্পাস আমাকে ডাকতে পারে, সেদিন সানন্দে আমি ফিরে আসবো। আমার ধর্ম আমার স্বকীয়তা। স্বকীয়তাকে বিসর্জন দিয়ে সফল হওয়াকে আমি প্রকৃত সফলতা ভাবতে নারাজ।’
নিজের অভিমতের ওপর মেয়েটার দৃঢ়তা আমাকে যদিও বা মুগ্ধ করেছে, তথাপি যে বোকামি সে করতে যাচ্ছে তার জন্যে আফসোস করা ছাড়া আর কীই বা করার থাকতে পারে? আমি বিষণ্ণ এবং হতাশ গলায় বললাম, ‘এটাই তোমার সর্বশেষ সিদ্ধান্ত?’
‘জি’, মেয়েটা একবাক্যে উত্তর দিলো।
এতোক্ষণ পর মেয়েটার বাবার দিকে নজর দেওয়া গেলো। ভদ্রলোকের চেহারা দেখে মোটেই বিচলিত কিংবা চিন্তিত বলে মনে তো হলোই না, বরঞ্চ মেয়ের এমন হঠকারী সিদ্ধান্তে তার যে অবাধ উস্কানি রয়েছে, সেটার প্রচ্ছন্ন ছায়া যেন চোখেমুখে লেপ্টে আছে। আরও বিস্ময়ের ব্যাপার হলো–আমাদের এতোক্ষণের আলাপচারিতায় ভদ্রলোক টু শব্দটিও করেননি। কিছুটা রাগ হলো আমার। মেয়েটা না-হয় অবুঝ। দুনিয়াটাকে সাদা-কালো জ্ঞান করছে। কিন্তু চুল-দাড়িতে পাক ধরা এই বয়স্ক ভদ্রলোকের কেন যে এমন ভীমরতি হলো তা বোঝা মুশকিল। মেয়ের এমন অবিবেচক সিদ্ধান্তে একজন বাবাকে এতোটা নির্ভার দেখতে বেশ দৃষ্টিকটুই লাগছে।
খানিকটা রুক্ষ এবং তীক্ষ্ণ গলায় বললাম, ‘আপনিই কি ওর বাবা?’
‘জি।’
‘আপনার মেয়ের এই সিদ্ধান্তকে আপনি সমর্থন করেন?’
বেশ হাসিখুশি চেহারায় লোকটা বললো, ‘অবশ্যই করি। কেবল সমর্থন নয়, আমি দারুণভাবে এপ্রিশিয়েট করি।’
আমি বেশ হকচকিয়ে গেলাম ভদ্রলোকের কথা শুনে! ভালো একটা ডিপার্টমেন্টে পড়ে মেয়েটা। গ্র্যাজুয়েশানটা শেষ করতে পারলেই ভালো ক্যারিয়ারের হাতছানি সামনে। এমন অবস্থায় খুবই সামান্য একটা ইস্যুতে পড়াশোনাই ছেড়ে দিতে চাচ্ছে, আর সেটাকে বসে বসে নাকি এপ্রিশিয়েট করছে তার বাবা! এমন পাগলও হয় দুনিয়ায়?
কপাল কুঁচকে আমি বললাম, ‘আপনার কাছে এটাকে এপ্রিশিয়েট করবার মতো কোনো ব্যাপার বলে মনে হচ্ছে?’
আমার কপালের ভাঁজ-রেখা ভদ্রলোককে বিভ্রান্ত কিংবা চিন্তিত কোনোটাই করতে পারলো না। চেহারায় আগের মতোই হাসি হাসি ভাব জিইয়ে রেখে তিনি বললেন, ‘কেন নয়, বলুন? আমার মেয়ে দুনিয়ার জীবনের প্রাপ্তির বদলে আখিরাতের প্রাপ্তিকে বড় করে দেখতে শিখেছে। অর্থনীতিতে ‘অপরচুনিটি কস্ট’ বলে একটা ব্যাপার আছে। বিশাল কিছু পাবার আশায় ক্ষুদ্র কিছু ত্যাগ করার নামই হলো অপরচুনিটি কস্ট। আমার মেয়ে অনন্ত জীবনের সফলতার জন্য দুনিয়ার ক্ষণিক সফলতাকে জলাঞ্জলি দিতে চাইছে–মুসলিম বাবা হিশেবে এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আমার জন্য আর কিছুই হতে পারে না।’
জাদুশক্তির ওপরে আমার কোনো আস্থা কোনোকালেই ছিলো না। কিন্তু সেদিন ভদ্রলোকের কথাগুলো আমাকে এমনভাবে মোহগ্রস্ত করে ফেলে যে, মুহূর্তের জন্য মনে হলো আমাকে কেউ জাদু করেছে। তার সাদামাটা কথাগুলোর ভাঁজে আমি এমন ভার, এমন তৃপ্তি আর আত্মতুষ্টির সন্ধান পেলাম, যা আমি জীবনভর খুঁজে চলেছি। জীবন নিয়ে এভাবেও ভাবা যায়? এমন জীবনদর্শনও মানুষ অন্তরে লালন করতে পারে? স্বার্থপরতার এই দুনিয়ায় এমন মানুষও আছে, যারা জীবনের গোলকধাঁধায় ভড়কে যায় না, হারিয়ে যায় না? যারা অনুপম আদর্শকে বুকে ধারণ করে তার জন্য জীবনের সবটুকু সুখ, সবটুকু আহ্লাদকে ছেড়ে দিতে পারে? আমি ভাবলাম–আমার ছেলেটাকেও যদি এ রকম দীক্ষা দিতে পারতাম! যদি বলতে পারতাম–এটাই তোমার শেষ গন্তব্য নয়। এরপরে অনন্ত এক গন্তব্যে তোমাকে পাড়ি জমাতে হবে। সেই গন্তব্যের পথকে মসৃণ রাখতে তোমাকে ত্যাগ করতে হবে দুনিয়ার সকল মোহ।’
ইশ! যদি সত্যিই তাকে এভাবে মানুষ করতে পারতাম, আজ আমিও কি বাবা হিশেবে গর্ববোধ করতে পারতাম না? ছেলে মাদকাসক্ত, মাতাল আর নষ্ট হয়ে গেছে বলে কি বুকে এক জগদ্দল পাথরের স্তূপ আমাকে বয়ে বেড়াতে হতো?
দরখাস্তটার ওপর আবার চোখ পড়লো আমার। মেয়েটা একেবারে শেষে নিজের নাম লিখেছে এভাবে–আয়িশা বিনতু আলাদিন। আলাদিন নামটা দেখেই এতো দুঃখ-কষ্টের মাঝেও আমি কেন যেন ফিক করে হেসে ফেললাম। আমাদের কৈশোরের সেই আলাদিনের স্মৃতি আমার অবচেতন মন কীভাবে যেন মস্তিষ্কের স্মৃতিঘর থেকে খুঁজে বের করে এনেছে। আমার কপালের ভাঁজ লোকটাকে বিভ্রান্ত করতে না পারলেও, আমার ফিকে হাসিটা তাকে ঠিকই বিভ্রান্ত করে দিলো। ভদ্রলোক নিজ থেকেই বললেন, ‘দুঃখিত স্যার, একটা কথা জানতে চাইছি। দরখাস্তটা দেখে একটু আগে আপনি হেসে ফেললেন দেখলাম। এখানে কি ভুল কিংবা অসৌজন্যমূলক কিছু লেখা আছে?’
আমার হাসিটা যে মৃদু কোনো হাসি ছিলো না; বরং চোখে লাগার মতোই ছিলো– তা বুঝতে পারলাম হাসির ব্যাপারে ভদ্রলোকের চোখমুখ ভরা পেরেশানি দেখে। তাকে অভয় দিয়ে বললাম, ‘সেরকম কিছু না আসলে। আপনার নামটার সাথে আমার কৈশোরের সুন্দর কিছু স্মৃতি জড়িয়ে আছে। দরখাস্তে আপনার মেয়ের নামে চোখ পড়ে যেতেই আমি খানিকটা স্মৃতিকাতুরে হয়ে পড়েছিলাম।’