একদিন বাসায় এসে দেখি রেবেকা মনমরা হয়ে সোফায় বসে আছে। তার মুখাবয়বে বিষাদের অনিঃশেষ রেখা অঙ্কিত। দীর্ঘ ত্রিশ বছরের সংসার জীবনে তাকে সেদিনের চেয়ে বিমর্ষ, সেদিনের চেয়ে বিধ্বস্ত আমি আর কখনোই দেখিনি। মুখে সর্বদা হাসি জিইয়ে রাখার এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিলো তার। আমি যতোখানি রাশভারী, সে ঠিক ততখানিই হাসিখুশি। তার অকারণ হাসির চোটে আমার মাঝে মাঝে রাগ উঠে যেতো। সেই হাসিখুশি, প্রাণোচ্ছল আর প্রফুল্লতায় ভরপুর আত্মার মানুষটিকে এমন বিমর্ষ, বিহ্বল চেহারায় দেখে আমার বুকের ভেতরটা কোনো এক অজানা আশঙ্কায় ধুকপুক করে উঠলো। কোথা হতে যেন বিপদের করুণ বীণ বেজে বেজে একটি সমূহ দুর্যোগের আভাস ধেয়ে আসছে আমার কানে। সেই বিধ্বংসী, বিনাশী সুরের অকৃপণ যাতনায় আমি যেন বিমূঢ় হয়ে গেলাম ক্ষণিকের জন্য।
খুব দুর্বল চিত্তের মানুষ আমি। যেকোনো কিছুতেই অস্থির হয়ে পড়ার বাতিক রয়েছে। তবুও, ভেতরে একটু শক্তি সঞ্চয় করে নিয়ে বললাম, রেবেকা, ওমন মলিন মুখে বসে আছো যে? কোনো সমস্যা?
সমস্যা যে হয়েছে সে ব্যাপারে আমি নিঃসন্দেহ। তাও প্রশ্ন করার জন্যই প্রশ্ন করা। রেবেকা আমার দিকে তাকাতেই হুড়মুড় করে তার দু-চোখ বেয়ে নেমে এলো শ্রাবণ ধারার জল। সারাটা জীবনের সবটুকু মেঘ সম্ভবত তার চোখে আজকের জন্যই জমা হয়ে ছিলো। সুযোগ পেয়ে বাঁধভাঙা ঢেউয়ের মতন বুকে আছড়ে পড়লো সেই মেঘভাঙা বৃষ্টির দল। তাকে কোনোরকমে শান্ত করে জিগ্যেশ করলাম, ‘কী হয়েছে বলবে তো?’
আমার বুকে মাথা খুঁজে গোঙাতে থাকে রেবেকা। সে এক অদ্ভুত বিষাদের গোঙানি। রংহীন সেই বিষাদের মর্মযাতনা আমার বুকের ভেতরটাকে যেন এফোঁড়ওফোঁড় করে দিয়ে গেলো।
[তিন]
মাদকে আসক্ত এক সন্তানের পিতা আমি–ভারি দুঃস্বপ্নেও নিজেকে এ অবস্থায় ভাবা আমার পক্ষে অসম্ভব। সারা জীবনের নীতি-নৈতিকতা, আদর্শ মানুষ হওয়া এবং আদর্শ মানুষ তৈরির স্বপ্ন দেখা এই আমার পক্ষে নিজের একমাত্র ছেলেকে মাদকের দুনিয়ায় হারিয়ে যেতে দেখে যেন আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেলো। এক গভীর চোরাবালির স্তূপে আমি যেন নিমজ্জিত হতে চলেছি, সাথে অপমৃত্যু ঘটছে আমার সকল স্বপ্ন আর সাধনার। যে সন্তানকে নিজের যোগ্য উত্তরসূরি, যোগ্য উত্তরপুরুষ বানাবার প্রবল ব্ৰত আমার মনে, মাদকের নেশায় অন্যায়ে জড়িয়ে পড়া সেই সন্তানকে গ্রেপ্তারের পরোয়ানা জানিয়ে গেছে পুলিশ কর্তৃপক্ষ। আমার মতো বাবাদের জন্যে এমন লজ্জাকর, এমন মাথা হেঁট করা দিন দেখবার চাইতে মৃত্যু ঢের উত্তম!
জীবনের কাছে আমার পাওনা ছিলো অঢেল আর প্রত্যাশা ছিলো সীমাহীন। সারাজীবন আলো ফেরি করে বাঁচতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সেই আলো যে নিজের ঘরে জ্বালাতে পারলাম না–এই দুঃখবোধ আমি ঘুচাবো কেমন করে? তাহলে কি জীবন আমার সাথে ছলনা করলো? তবে কি ভাগ্যের কাছে আমি পরাস্ত হয়ে গেলাম?
থানা থেকে আসা অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট কপিটা হাতে নিয়ে আমি ধপ করে সোফায় বসে পড়লাম।
[চার]
বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে একটা ব্যাপার নিয়ে বেশ শোরগোল শুনতে পেলাম। সম্ভবত আমার ডিপার্টমেন্টের কোনো এক ছাত্রীকে নিয়েই। সাদামাটা ব্যাপার, অন্যদের টেবিলে গড়িয়েই ব্যাপারটার সুরাহা করার সুযোগ থাকলেও তা হলো না। সেটা গড়িয়েছে আমার টেবিল পর্যন্ত। হলুদ খামে ভরা একটা চিঠি আমার টেবিলের ওপরে রাখা। চিঠি না বলে ওটাকে দরখাস্ত বলাটাই শ্রেয়। একবার ইচ্ছে হলো জিনিসটাকে আবর্জনার বিনে ছুঁড়ে ফেলে দিই। পরক্ষণে মনে হলো–যে গাধাটা এই বস্তুটা আমার টেবিল পর্যন্ত পৌঁছিয়েছে তাকে ডেকে আচ্ছামতো ঝেড়ে দিই। শেষ পর্যন্ত কোনোটাই করা হলো না। নিতান্ত অনিচ্ছাকৃতভাবে হলুদ খামে মোড়ানো সেই দরখাস্তটা আমি ধীরহস্তে খুলে পড়তে শুরু করলাম।
পিয়নকে ডেকে বললাম, ‘এই দরখাস্তটা যার, তাকে বলো আমার রুমে আসতে।’
পিয়ন ‘জি স্যার’ বলে এক দৌড়ে ছুটে বেরিয়ে গেলো। বেশ খানিকক্ষণ পর আগাগোড়া বোরকায় ঢাকা একটি মেয়ে, তার সাথে একজন মধ্যবয়েসী লোক আমার রুমে এলো। উভয়কে বসতে বলে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘এই দরখাস্ত তুমিই লিখেছো?’
মেয়েটা আস্তে করে বললো, ‘জি স্যার।’
‘হিজাব পরে ক্লাস করা যাবে না–এটা তোমাকে কে বলেছে?’
‘আমাদের একজন ম্যাডাম।’
‘উনি যা বলেছেন তা আমাকে বিস্তারিত খুলে বলো।’
‘ম্যাডাম বলেছেন হিজাব পরে ক্লাসে আসা যাবে না। ক্লাস করতে হলে এ রকম বোরকা-হিজাব ছাড়াই করতে হবে। আমার অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও ম্যাডাম আমার কোনো কথা শুনতে রাজি হননি। সাফ জানিয়েছেন আমাকে পরের সেমিস্টারে এক্সাম হলেও বসতে দেবেন না, যদি না আমি আমার হিজাব ছাড়তে রাজি হই।‘
‘তোমার সিদ্ধান্ত কী এখন?’
‘স্যার, আমার সিদ্ধান্ত হলো–হিজাব পরে ক্লাস করতে না দিলে আমি আর এখানে পড়াশোনা করবো না।’
‘তুমি কি ভেবেচিন্তে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছো?’
‘জি।’
‘ক্যারিয়ারের কথা একবারও ভেবেছো কি? তোমার রেজাল্ট দেখলাম বেশ চমৎকার। একটা ভালো সাবজেক্টে পড়ছো তুমি। তোমার সামনে যে অবাধ সাফল্য অপেক্ষা করছে, তা তুমি বুঝতে পারছো?’
মেয়েটা কিছু না বলে খানিকক্ষণ চুপ করে রইলো। তার নীরবতার সুযোগ নিয়ে পুনরায় বললাম, ‘তোমার যে রেজাল্ট এবং যে সাবজেক্ট তা কতো শিক্ষার্থীর সারাজীবনের আরাধ্য স্বপ্ন তুমি বলতে পারো? তোমার জন্য অপেক্ষা করে আছে। সাফল্যমণ্ডিত ক্যারিয়ার, আর তুমি সব ছেড়ে-ছুঁড়ে চলে যেতে চাইছো?’