স্কুল ছুটির পর গেটের বাইরে তার বিশালাকার শরীর নিয়ে পায়চারি করছিল মুনতাসির। বুঝতেই পারছি আলাদিনের ওপরে সে বেজায় চটেছে। হাতির পাড়া আর মুনতাসিরের থাবা–দুটোই আমাদের কাছে সমান জিনিস। আলাদিনের জন্য যে এক মহাদুর্যোগ বাইরে ঘুরপাক খাচ্ছে–সেই আভাস আলাদিনের কাছে পৌঁছেছে। কিনা কী জানি!
নাহ, পোঁছেনি। হাবাগোবা আলাদিন নরম নরম পা ফেলে স্কুল থেকে বেরিয়ে এলো। যেই না সে গেটের মুখে এলো, ওমনি ছোঁ মেরে তাকে একপাশে নিয়ে গেলো মুনতাসির। যেন বাঘের থাবায় বন্দী হরিণ! শিকারি ঈগল লক্ষ্যভ্রষ্ট হতে পারে, কিন্তু মুনতাসিরের থাবা কখনোই ব্যর্থ হয় না। বেচারা আলাদিন ঘটনার আকস্মিকতায় পুরোই জব্দ! মুখ দিয়ে কোনো শব্দ ছাড়াই ভ্যাবাচ্যাকা চেহারা নিয়ে অপলক তাকিয়ে রইলো মুনতাসিরের চেহারার দিকে।
অন্যদিন হলে জবাবদিহির আগেই হয়তো মুনতাসির দু-চারটে লাগিয়ে দিতো। কিন্তু আজ তার ব্যতিক্রম হলো। এই হাবাগোবাটার বেলাতেই সবাই কেন নিজেদের সত্তাকে বিসর্জন দিয়ে দেয় সে এক রহস্য! যাহোক, আলাদিনের শার্টের কলার টেনে ধরে, তার সুপারির সমান ছোটো মুখটাকে নিজের মুখের কাছে এনে মুনতাসির জানতে চাইলো, ‘এতো ভাব কীসের তোর? তখন যে জানতে চাইলাম খাচ্ছিস না কেন, ভাব দেখিয়ে চলে গেলি কেন? তুই আমাকে চিনিস?’
মুনতাসিরকে চেনে না এমন পোড়ামুখো আমাদের স্কুলে একটাও নেই। যারা চেনে না তারাও তার গল্প শুনতে শুনতে তাকে চিনে ফেলে। সম্ভবত হাবাগোবা আলাদিনও চেনে। সে মুখ নিচু করে বললো, ‘আমি সিয়াম রেখেছি। আমি যে সিয়াম রেখেছি সেটা কাউকে জানাতে চাচ্ছিলাম না। তাই তোমার প্রশ্নের উত্তর দিইনি।’
এমন দিনে কেউ সিয়াম রাখে বলে জানা নেই আমাদের। সিয়ামের মাস তো কবেই গত হয়েছে। ব্যাটা নিশ্চয় ঢপ দিচ্ছে! পাশ থেকে মুখে আঙুল চুষতে চুষতে আমিনুল বলে উঠলো, ‘ব্যাটা তো সাংঘাতিক মিথ্যুক রে! এখন কি সিয়ামের মাস নাকি যে সিয়াম রেখেছিস?’
‘সিয়ামের মাস ছাড়াও তো সিয়াম রাখা যায়। এগুলোকে বলে নফল সিয়াম। প্রতি সোম আর বৃহস্পতিবার সিয়াম রাখতেন আমাদের নবি।’
আমিনুল পাল্টা জিগ্যেশ করলো, ‘কে শিখিয়েছে তোকে এই নতুন জিনিস?’
আলাদিন বললো, ‘আমার বাবা রাখেন। বাবাকে দেখে দেখে আমরাও শিখেছি। সপ্তাহের সোম আর বৃহস্পতিবার আমাদের বাসার সবাই সিয়াম রাখে।’
ধপ করে তার কলার ছেড়ে দিলো মুনতাসির। কিছু না বলেই হনহন করে সে হাঁটা ধরল বাড়ির পথে। আমরা একে-অন্যের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলাম। যে দৃশ্য উপভোগ করার জন্যে সবাই এতোক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে, তাতে যে এভাবে জল ঢেলে দেওয়া হবে, তা কে জানতো? সেদিনও আসন্ন ঝড়ের তাণ্ডবলীলা আসি আসি করে আর আসল না। নিত্যকার মতো, সেদিনও বেঁচে গেলো হাবাগোবাটা।
ইতঃপূর্বে যা কোনোদিন ঘটেনি একদিন তা-ই ঘটলো। পাশে বোমা ফাটলেও যে আলাদিনের মুখ দিয়ে একটা শব্দ বের হয় না, যে কোনোদিন নিজ থেকে এসে আমাদের সাথে একটা কথাও বলে না, সে-ই কিনা একদিন আমাদের আড্ডার মাঝে এসে বললো, ‘আযান হচ্ছে। তোমরা কেউ কি সালাতে যাবে?’
তাকে নিজ থেকে এসে আমাদের সাথে কথা বলতে দেখে বিস্ময়ে হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম! আমাদের দিক থেকে কোনো উত্তর তো পায়ইনি সে, তদুপরি আমাদের বিস্ময়মাখা চেহারাগুলো দেখে সেও সম্ভবত হকচকিয়ে গেছে কিছুটা। আবার কথা বললো আলাদিন। খুবই গোছালো, স্পষ্ট ভাষায়–
‘যুহরের আযান হচ্ছে। আমার সাথে মসজিদে যাবে? এই যে দেখো, মুয়াজ্জিন বলছে, ‘হাইয়্যা আলাল ফালাহ’। মানে হলো–সফলতার পথে এসো। জীবনে সফল হতে চাইলে চলো আমরা সালাতে যাই।’
এতোদিন শুনেছি জীবনে সফল হতে হলে ভালোমতো পড়াশোনা করতে হয়। আজ এই হাবাগোবাটার কাছে নতুন তত্ত্ব শুনলাম বৈকি! সালাতে গেলে নাকি মানুষ সফল হয়! সফলতা বলতে ও কী কচু বোঝে কে জানে! ওর কথায় আমরা কেউ কর্ণপাত করিনি সেদিন। ওর মতো হাবাগোবা, পড়াশোনায় ঢের পিছিয়ে থাকা এক বালকের কাছ থেকে সফলতার পাঠ নেব আমরা? সম্ভবত দুনিয়ায় সফলতার পাঠ দেওয়ার মতো মানুষের তখনো আকাল পড়ে যায়নি।
এরপর? এরপর বলা নেই কওয়া নেই একদিন হুট করেই বাবার বদলি হয়ে যায়। আমাদের পাড়ি জমাতে হয় অন্য একটা শহরে…
[দুই]
ক্যামব্রিজ থেকে পোস্ট-ডক শেষ করে দেশে ফিরেছি। চারদিকে হইচই ফেলে দেওয়া ‘গড পার্টিকেল’ থিওরির রিসার্চ টিমের অন্যতম সদস্য হওয়ায় আমার তখন দুনিয়াজোড়া খ্যাতি। চাইলেই বিদেশে ভালো ক্যারিয়ার নিয়ে থিতু হওয়া যেতো অনায়েশেই, কিন্তু মন আমার পড়ে রইলো দেশের জল-হাওয়া-মাটিতে। দেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে দেখতে বড় হওয়া আমাকে শেষ পর্যন্ত ফিরে আসতে হলো শেকড়ের টানে। দেশের নামকরা একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিশেবে যোগদান করে হাঁটতে শুরু করলাম আমার লালিত সেই স্বপ্নের পথে।
সময় বয়ে যাচ্ছিল তার নিজস্ব গতিতে। সেই গতিতে কোথাও কোনো হেরফের নেই। সে না দ্রুত না মন্থর। দিন যায়, মাস পেরোয়, বছর ঘুরে আসে–জীবনের ঝুলিতে জমা হতে থাকে হরেক রকমের অভিজ্ঞতা। তবে, একদিন এমন এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হলো, যা আমাকে একেবারে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিয়ে যায়। যে অভিজ্ঞতা ভেঙে চুরমার করে দেয় আমার সকল অহংকার আর অহমিকাবোধ। জীবনের কাছে আমি যেন নিতান্তই শিশু হয়ে পড়ি। আমার ইচ্ছে করে হাউমাউ করে কাঁদতে। কিংবা যদি জীবন থেকেই পালিয়ে যেতে পারতাম! যদি হারিয়ে যেতে পারতাম সময়ের অজানা কোনো স্রোতে, তাহলেই সম্ভবত মুক্তি মিলতো। কিন্তু, জীবন কি আর পুতুল খেলার মতো? মন চাইলো খেলোম আর মন না চাইলেই খেলা ভেঙে দিয়ে উঠে গেলাম? জীবন এক কঠিন বাস্তবতার নাম; এমন এক শিকলের নাম, যার বাঁধন থেকে মৃত্যু ব্যতীত কারও নিস্তার নেই।