শফিকের কথা শুনে ক্লাসশুদ্ধ ছেলেমেয়ে হো হো করে হাসিতে ফেটে পড়লো। এমনকি, একটু আগে টুলে বসে বসে ঝিমুতে থাকা সানজিদাও সেই অট্টহাসিতে লুটোপুটি খাওয়ার মতন অবস্থা। হাসলো না কেবল হাবাগোবা আলাদিন।
হ্যাঁ, সেদিন থেকে আমরা তার নাম রেখেছিলাম হাবাগোবা আলাদিন।
টিফিন পিরিয়ডের পরেই ছিলো বিজ্ঞান ক্লাস। বিজ্ঞান শব্দটা তখন যতখানি না ভয়ংকর, তার চাইতে বেশি ভয়ংকর ছিলো আমাদের বিজ্ঞান স্যার। হাতির মতন বিশাল দেহ স্যারের। যেদিক দিয়ে হাঁটেন সেদিকটা মনে হয় গমগম করতে থাকে। তার ক্লাস ফাঁকি দেওয়া তো দূর, কেউ হালকা টুঁ শব্দ করবে–এতোবড়ো বুকের পাটা কারও ছিলো না। যে শফিক হাসি-ঠাট্টা করে ক্লাস মাতিয়ে রাখত, সে পর্যন্ত বিজ্ঞান ক্লাসে কাঁকড়ার মতো হাত-পা গুটিয়ে ভালো ছেলের মতো বসে থাকত।
প্রথম দিনেই বিপত্তি বাধালো হাবাগোবা আলাদিন। টিফিন পিরিয়ড থেকেই সে একেবারে লাপাত্তা। আমরা ভাবলাম প্রথম দিনেই এই স্কুলে পড়ার খায়েশ তার মিটে গেছে। তাই হয়তো বা বইটই রেখে একদম বেওয়ারিশের মতো পালিয়েছে। ওকে দিয়ে আর যা-ই হোক, পড়াশোনাটা যে হবে না, সেটা সম্ভবত ও বুঝে গেছে। তাই সুযোগ বুঝে চম্পট!
বিজ্ঞান ক্লাসের তখন মাঝামাঝি সময়। আমাদের সম্মিলিত দৃষ্টি সামনের ব্ল্যাকবোর্ডে গিয়ে স্থির হয়ে গেছে। যার দৃষ্টি সেখান থেকে বিচ্যুত হবে, তার ওপর দিয়ে বয়ে যাবে এক প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়। এই ক্লাসের এটাই চিরাচরিত রীতি। এতোটুকু প্রাণ নিয়ে আমরা প্রতিদিন এই সময়টা পার করি।
কিন্তু সেদিন, সবাইকে অবাক করে দিয়ে কোথা থেকে যেন ঝড়ের মতো ক্লাস-রুমের দরজার কাছে এসে হাজির হলো হাবাগোবা আলাদিন। তাকে দেখে ভূত দেখার মতোই চমকে উঠলাম আমরা সবাই। নিজেদের চোখগুলোকে অবিশ্বাস করতে পারলেই বেশি ভালো লাগত; কিন্তু রক্ত-মাংসের দেহ নিয়ে যে দাঁড়িয়ে আছে দরজার কাছে, তার অস্তিত্বকে অস্বীকার করি কী করে?
তার পুনরাগমনের ঘটনায় সেদিন আমরা বিস্মিত হইনি। আমরা বিস্মিত হচ্ছিলাম তার ওপর দিয়ে বইতে যাওয়া আসন্ন ঝড়ের তাণ্ডবলীলা কল্পনা করে। আমাদের চোখের সামনে তখন একটাই দৃশ্য। টেবিলের নিচে মাথা ঢুকিয়ে দিয়ে পিঠখানা উপুড় করে রেখেছে হাবাগোবা আলাদিন। ম্যাড়ম্যাড়ে সেই পিঠে বিজ্ঞান স্যারের সাড়ে ছ’ কেজি ওজনের কিলগুলো পড়ছে আর তাতে পটাশ পটাশ শব্দ হচ্ছে। এই কিলগুলো হজম করার পর সে যে আর কোনোদিন এ স্কুলমুখী হবে না–সে ব্যাপারে আমরা মোটামুটি নিশ্চিত।
আমাদের বিজ্ঞান স্যার সরু চোখে ওর দিকে তাকালেন। ভয়ানক ক্ষুধার্ত সিংহ। তার আহারের সময় উটকো ঝামেলায় যে ধরনের বিরক্তি প্রকাশ করে, স্যারের চোখেমুখেও সে-রকম তিরিক্ষি ভাব। স্যারের মুখাবয়বের আশু পরিবর্তনে তখন আমাদের হাঁটু পর্যন্ত থরথর করে কাঁপতে শুরু করেছে, বাইরে দণ্ডায়মান হাবাগোবাটার যে কী অবস্থা কে জানে!
সে তখনো বাইরেই দাঁড়ানো। ইশারায় তাকে ভেতরে আসতে বললেন। দোর্দণ্ডপ্রতাপের বিজ্ঞান স্যার। ধীরপায়ে ভেতরে ঢুকে স্যারের কাছাকাছি আসতেই তার পেটে চাপ দিয়ে বললেন, ‘নাম কী?’
মিনমিন করে সে বললো, ‘আলাদিন’।
‘আজকেই প্রথম এসেছিস ক্লাসে?’
ভয়ে ভয়ে জবাব এলো, ‘জ্বি।’
‘তুই কি জানিস ক্লাস অর্ধেক শেষ হয়ে গেছে?’
মাথা নিচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে রইলো আলাদিন। তাকে নিরুত্তর হতে দেখে এবার তার পেটে আরেকটু জোরে চাপ দিয়ে ধরলেন স্যার। স্যারের অভিজ্ঞ হাতের এমন নাড়ানি খেয়ে একবার কোঁত করে উঠলো সে। স্যার বললেন, ‘এতো দেরি হওয়ার কারণ কী? কোথায় গুল মারছিলি?’
তার দৃষ্টি তখনো মাটিতেই নিবদ্ধ। নিচু দৃষ্টি এবং নিচু স্বরে সে বললো, ‘স্যার, যুহরের সালাত পড়ার জন্য মসজিদে গিয়েছিলাম। মসজিদ বেশ খানিকটা দূরে। এ জন্যেই দেরি হয়ে গেছে।’
নতুন বলে দয়া করে হোক কিংবা সালাতের কথা শুনে সমীহ করেই হোক, সেদিন হাবাগোবা আলাদিনের পিঠের ওপর দিয়ে যে টর্নেডো বয়ে যাওয়ার দৃশ্য আমরা কল্পনা করেছিলাম, সেটা আর বাস্তব রূপ পেলো না। স্যার তাকে বললেন, ‘ঠিক আছে। যা, নিজের জায়গায় গিয়ে বোস।’
আমাদের অঙ্ক স্যার তাকে ডাকত ‘আদু ভাই’ বলে। স্যারের ধারণা ছিলো সে কোনোদিনও পরের ক্লাস টপকাতে পারবে না। একদিন স্যার তার কাছে জিগ্যেশ করলেন, ‘তুই বড় হয়ে কী হবি রে আদু ভাই?’
সে কিছু না বলে মাথা নিচু করে থাকলো। স্যার বললেন, ‘আমি বলি তুই কী হবি? তুই হবি মুদি দোকানদার! হা হা হা! বসে বসে মুড়ি বেচবি।’
স্যার এভাবেই তাকে অপমান করতেন আর হাসতেন। স্যারের সাথে হাসতাম আমরাও। ও-ই কেবল মাথা নিচু করে থাকত। লজ্জা আর অপমানে।
চুপচাপ স্বভাবের সেই হাবাগোবা আলাদিন টিফিন পিরিয়ডের পর নিয়ম করেই দেরি করে আসতো এবং অদ্ভুত হলেও সত্য, বিজ্ঞান স্যার কেবল তার জন্য নিজের চিরাচরিত নিয়ম থেকে সরে আসতেন। হাবাগোবাটার জন্যে যেন সাতখুন মাপ!
অন্য আরেকদিনের ঘটনা। বন্ধুদের নিয়ে আয়েশ করে টিফিন খাচ্ছিলাম। আমাদের পাশ দিয়ে হাবাগোবা আলাদিন হেঁটে যাওয়ার সময় মুনতাসির চেঁচিয়ে বললো, ‘কীরে মুদি দোকানদার! খাচ্ছিস না যে?’
মুনতাসিরের এহেন পচানি গায়ে মাখলো না সে। মাথা তুলে একবার শুধু আমাদের দিকে তাকালো; এরপর সুড়সুড় করে হেঁটে চলে গেলো নিজের কাজে। ব্যাপারটা বেশ গায়ে লাগলো মুনতাসিরের। বলাই বাহুল্য, শক্তি, তেজ আর শরীরের সাইজে মুনতাসির ছিলো আস্ত একটা পালোয়ানের সমান। আমরা তো বটেই, আমাদের উঁচু ক্লাসের ছাত্ররাও তার সাথে উল্টাপাল্টা করার সাহস পায় না। যাকে-তাকে ধরে ঠেঙিয়ে দেয়ার ব্যাপারে মুনতাসিরের কুলজোড়া খ্যাতি। সেই মুনতাসিরের কথাকে অগ্রাহ্য করে চলে যায় কিনা আলাদিনের মতন এক তালপাতার সেপাই!