[আট]
সাপ্তাহিক নয়াদিন পত্রিকার ঠিকানায় একটা চিঠি পাঠাচ্ছে হোসেন। সাথে খামে মোড়ানো তার লেখা মহীয়সী গল্পটাও।
বরাবর,
সম্পাদক
সাপ্তাহিক নয়াদিন
জনাব, আমার প্রীতি জানবেন। আপনার সাথে কাটানো মধুময় সময়গুলো উপভোগ করেছি বেশ। পাড়া-গাঁ থেকে যাওয়া একজন নিতান্ত সাধারণ যুবকের লেখার যে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা আপনি করেছেন, তাতে আমি রীতিমতো মুগ্ধ হয়েছি। আপনার অকৃপণ আন্তরিকতা এবং হৃদ্যতা অনেকদিন মনে রাখবো। আপনার সাথে আমার শেষ সাক্ষাৎটা যথেষ্ট আন্তরিকতার ছিলো না বলে আমি ভীষণ দুঃখিত। আপনি জেনে আনন্দিত হবেন যে–মহীয়সী শিরোনামের গল্পটা আমি শেষ পর্যন্ত লিখতে পেরেছি। তবে, এই গল্প সুলেখা সাথীর নয়,
আমার মা জাহানারা বেগমের। মহীয়সী বলে যদি কাউকে কল্পনা করতে হয়, মা তখন আমার কাছে সবথেকে সেরা উদাহরণ। সেই ছোটোবেলায় বাবাকে হারানোর পর থেকে মায়ের সংগ্রাম দেখতে দেখতে বেড়ে উঠেছি আমি। স্বামী হারানো একজন সরলা নারীর জীবনে যতোখানি সংগ্রামের গদ্য আর পদ্য থাকতে হয়, আমি দেখেছি, আমার মায়ের জীবনে তার সবটাই ভীষণ-রকম উপস্থিত। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো, এই মহীয়সী নারী-চরিত্রকে এতো কাছে থেকেও আমি এতোদিন চিনতে পারিনি। বুঝতেও পারিনি তার ত্যাগের মাহাত্ম্য, আবিষ্কার করতে পারিনি তার সংগ্রামের সাহসী গল্পটাকে। নয়াদিন পত্রিকাকে আরও একটা ধন্যবাদ এই কারণে যে, সুলেখা সাথী নামের একজনের মুখোমুখি তারা আমাকে না করলে হয়তো আমার মায়ের গল্পটা আমার সামনে কখনোই ভাস্বর হয়ে উঠতো না। আমি হয়তো কখনোই অনুধাবন করতে পারতাম না একজন সত্যিকারের মহীয়সী কাকে বলে। আপনাদের পছন্দের চরিত্রকে মহীয়সীরূপে চিত্রায়িত করতে না পারার জন্যেও দুঃখিত। আমি জানি না তিনি সত্যিকারের মহীয়সী চরিত্র কি না, তবে গল্পের মহীয়সীকে নিয়ে একবিন্দুও সংকোচ নেই আমার। আমার কাছে তিনিই অনন্যা, তিনিই মহীয়সী। তাই তার গল্পটাই লিখে পাঠালাম।
ইতি
হোসেন
হোসেন জানে তার এই গল্প নয়াদিন পত্রিকা কোনোদিন ছাপাবে না। এই গল্পে শহুরে আভিজাত্য নেই, নেই চোখধাঁধানো প্রাসাদ কিংবা হুংকার আর তর্জন-গর্জনের উপাদান। এই গল্প এক গ্রামীণ সাধারণ নারীর গল্প। এই গল্প নিয়ে অন্তত আর যা-ই হোক–বাণিজ্য হবে না। কিন্তু গল্পটা লিখতে পেরে হোসেন পুলক অনুভব করছে। সত্যকে আলিঙ্গন আর মুখোশের আড়ালে থাকা মিথ্যাকে পায়ে ঠেলতে পারার আনন্দে আনন্দিত সে।
১৪. সফলতা সমাচার
[এক]
আমি তখন হাইস্কুলে পড়ি। বিদ্যের জাহাজ হবার স্বপ্নে বিভোর। জগতের সবকিছু নিয়েই যেন আমার নিরন্তর কৌতূহল। এটা-ওটা নিয়ে সারাক্ষণ ক্লাসে স্যারদের প্রশ্ন করতাম। আমার জিজ্ঞাসা-যন্ত্রণায় স্যারেরা তো অতিষ্ঠই, এমনকি আমার সহপাঠী, যারাও আমার মতো দুরন্ত আর দস্যিপনায় দুর্বিনীত, তারা পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে যেতো।
একদিন একেবারে হঠাৎ করে আমাদের ক্লাসে আগমন ঘটলো নতুন এক মুখের। ছোকরা যে আস্ত একটা হাবাগোবা সেটা তার চেহারা দেখলেই বিলক্ষণ বুঝে ফেলা যায়। ফ্যালফ্যাল তার চাহনি। শরীরের তুলনায় মাথাটা প্রকাণ্ড। ব্যাটা যে কেবল হাবাগোবা নয়; ভীষণরকম ভীতুও–সেটা বোঝা গেলো একটু পরেই। ইংরেজি ক্লাসের নাঈম স্যার এসে যখন তাকে কমন নাউনের দুটো উদাহরণ দিতে বললেন, ভয়ে তখন তার হাঁটু কাঁপাকাপি অবস্থা। একেবারে নতুন মুখ দেখেই স্যার জিগ্যেশ করলেন, ‘নাম কী?’
ছেলেটা মিনমিন করে বললো, ‘আলাদিন।’
আমাদের ক্লাসের সবচাইতে ফাজিলটার নাম ছিলো শফিক। যেকোনো কিছু নিয়ে মুহূর্তে কৌতুক বানাতে সে ছিলো সিদ্ধহস্ত। হাবাগোবাটার নাম ‘আলাদিন’ শুনে সে ঘাড় ফিরিয়ে বললো, ‘বাবা আলাদিন, চেরাগটা কি পকেটে পুরেছ না ব্যাগে?’
শফিকের এ ধরনের কৌতুক আমাদের সব সময় আলাদা মজা দেয়। তার কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠলাম আমরা সবাই। হাসলো না কেবল ছেলেটা। তার সেই আদি এবং অকৃত্রিম ফ্যালফ্যাল চেহারা নিয়ে সে স্যারের দিকে তাকিয়ে রইলো। একবার মনে হলো, এই ছেলেটার জন্ম না হলে ‘হাবাগোবা’ শব্দটা বুঝি অপূর্ণই রয়ে যেতো।
এরপর ছিলো বাংলা ক্লাস। দ্বিতীয় এবং সবচেয়ে মজার ক্লাস এইটাই। এক অসম্ভব রূপবতী ম্যাডাম আমাদের বাংলা পড়াতেন। রূপের কারণেই হোক কিংবা শখের কারণে–বাংলা ক্লাসে বাংলা পড়ানোর চেয়ে তিনি গল্পই করতেন বেশি। সেই গল্পগুলোর সবটা জুড়ে কেবল নিজের বন্দনা। সেদিনও তার ব্যক্তিক্রম হয়নি। বাংলা বইটায় একটুখানি চোখ বুলিয়ে পেছনের বেঞ্চের একটা মেয়েকে দাঁড় করিয়ে বললেন, ‘এই সানজিদা, ওমন ঝিমুচ্ছিস কেন? রাতে ঘুমোসনি? তোর মতন বয়েসে আমরা কতো সিনসিয়ার ছিলাম পড়াশোনা নিয়ে জানিস?’
ম্যাডামের আত্ম-বন্দনার গল্পগুলো সব সময় এভাবেই শুরু হয়। প্রথমে কারও কোনো খুঁত বের করবেন, এরপর ওই বিষয়ে ম্যাডাম কেন অনন্যা, অপ্রতিদ্বন্দ্বী, অপরাজিতা ছিলেন তা বর্ণনার মাধ্যমে মেলতে শুরু করে গল্পের ডালপালা। সানজিদাকে ধমকানির নেপথ্য-কারণও যে তা-ই, তা আমরা বিলকুল জানি। হলো ঠিক তা-ই। স্কুলজীবনে তিনি কেমন দুরন্ত ছিলেন, কেমন করে ক্লাসের ছেলেমেয়েদের ওপরে খবরদারি করতেন, ক্লাসে তার ভয়ে সবাই কীরকম তটস্থ থাকত, উপস্থিত বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় তার বক্তৃতা শুনে কীভাবে স্কুলশুদ্ধ লোকজন হা হয়ে গিয়েছিল– এসবই ছিলো গল্পের মূল বিষয়বস্তু। ম্যাডামের এমন ধারার গল্প শুনে হাই তুলতে তুলতে শফিক বললো, ‘ম্যাডাম, আপনার গল্প শুনে মনে হচ্ছে আপনি আসলে রাজনীতিবিদ হওয়ার জন্যেই জন্মেছিলেন; কিন্তু রাস্তা ভুল করে আপনি হয়ে গেছেন হাইস্কুলের টিচার।’