আনুষ্ঠানিকতা পর্ব শেষ হলে মঞে সুলেখা সাথীকে তার বক্তব্য প্রদানের জন্য আহ্বান করা হয়। স্টেজে উঠে সুলেখা সাথী নারীর অধিকার সচেতনতা, নারীর কাজ এবং জীবনের স্বাধীনতা, শৃঙ্খল থেকে নারীর মুক্তির নানান কায়দা-কানুন এবং কর্তব্যের কথা বলার পর বললেন, আমি এখানে দাঁড়িয়ে ওই গার্মেন্টস মালিক, যে কিনা তার একজন মহিলা কর্মীর গায়ে হাত তোলার দুঃসাহস দেখিয়েছে, তার যথোপযুক্ত শাস্তির দাবি করছি। নিঃসন্দেহে এটা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নারীকে শোষণের একটা করুণ দৃশ্যপট! একজন নারীকে অসম্মান করার, তার গায়ে হাত তোলার, তাকে অপমান-অপদস্থ করার অধিকার এই পুরুষ সমাজকে কে দিয়েছে? আমি আমাদের নারী সমাজকে বলতে চাই, আপনারা আপনাদের বেদনার কথা মন খুলে বলুন। আমরা পুরুষতান্ত্রিকতা বিবর্জিত, নারীর জন্য মুক্ত-স্বাধীন একটা দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখি, যেখানে নারী তার অধিকার বুঝে নেবে কড়ায়-গন্ডায়। নারী সমাজকে যে বা যারাই অপমান করতে চাইবে, শোষণ করতে চাইবে, তাদের বিরুদ্ধে আমরা গড়ে তুলব দুর্বার আন্দোলন। আগামীর বাংলাদেশ পুরুষের শোষণমুক্ত, নারী অধিকারের বাংলাদেশ।
মিস সুলেখা সাথীর কথাগুলো এরচে বেশি আর শুনতে পারল না হোসেন। রিমোট কন্ট্রোলে জোরে কষাঘাত করে টিভির সুইচ অফ করে দিলো সে। ভিজে যাওয়া নোটপ্যাডটার দিকে বারংবার তাকাচ্ছে হোসেন। কুঁচকে যাওয়া সেই কাগজগুলোর ভেতর থেকে যেন একটা প্রতিধ্বনি ভেসে আসছে–‘দুর হ এখান থেকে। আপদ কোথাকার! একটা কাজ ঠিকমতো করতে পারিস না!’
[ছয়]
‘কিন্তু মিস্টার হোসেন’, বললেন নয়াদিন সম্পাদক আদিত্য আদি, ‘আমরা আপনার ওপরে ভরসা করে অন্য কোনো অপশন চিন্তাও করিনি। এই মুহূর্তে এসে আপনি কিনা বলছেন যে, মহীয়সী গল্পটা আপনি লিখতে পারবেন না!’
হোসেন বেশ গম্ভীর গলায় বললো, ‘জি, আমি ঠিক করেছি ওই গল্পটা আমি লিখবো না।’
‘আমি পত্রিকার একজন সম্পাদক মাত্র, মিস্টার হোসেন। পত্রিকা কর্তৃপক্ষকে আমি কী জবাব দেবে আপনি বলতে পারেন?’
‘তাদের বলবেন, আমি গল্পটা লিখতে অপারগ। আমার অপারগতাকে তারা যেন ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখেন। ‘কিন্তু সমস্যাটা ঠিক কোথায় তা তো জানতে হবে, তাই না?’
‘সমস্যাটা পুরোটাই আমার। আমি আসলে এমন কাউকে নিয়ে গল্প লিখতে পারি না, যিনি তার কাজে, তার কথায় সৎ নন। যিনি নিজের ঘরে একজন অত্যাচারী, কিন্তু বহিরাবরণে বেশ ধরেন ত্রাণকর্তার।’
‘মিস্টার হোসেন, আমি বুঝতে পারছি না আপনার কথা।’
‘আপনাকে বুঝাতে পারছি না বলে ক্ষমাপ্রার্থী। এখানে স্বপ্নের মতো কিছু সময় কেটেছে আমার। এমন দুর্দান্ত মুহূর্তগুলো আমাকে উপহার দেওয়ার জন্যে কৃতজ্ঞতা। ভালো থাকবেন।’
আজীবনের লালিত একটা স্বপ্নকে পায়ে ঠেলে চলে যাচ্ছে হোসেন। একটা ভালো ক্যারিয়ার, একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ, একটা নির্মল, নিষ্কণ্টক জীবনের হাতছানিকে। কিন্তু হোসেন একটুও বেদনাহত নয়। স্বপ্নভঙ্গের যাতনা তাকে কাবু করেনি মোটেও। যে সত্যের মুখোমুখি হোসেন হয়েছে, সেই সত্যকে ধারণ করতে পারাটাও তার জীবনের সেরা একটা প্রাপ্তি।
মিস সুলেখা সাথীর জীবন নিয়ে মহীয়সী শিরোনামে একটা গল্প হোসেন যখন-তখন লিখে দিতে পারে। গল্পে মিস সুলেখা সাথীকে মহীয়সী, আলো হাতে চলা এক নির্ভীক নারীমূর্তি আর সমাজের এক অনন্য দর্পণ হিশেবে তুলে ধরতে হোসেনকে। একদমই বেগ পেতে হবে না। কিন্তু মিস সুলেখা সাথীর সাথে এই বিশেষণগুলো কতোখানি খাপ খায়? যে মহিলা নিজের ঘরের কাজের মেয়ের সাথেই সামান্য। ব্যাপারে এমন অমানবিক আচরণ করতে পারে, তার গায়ে হাত তুলতে পারে, সে যখন অন্য এক নির্যাতিত মহিলার জন্যে কাঁদে, জনসভা করে, রক্ত-গরম করা বক্তৃতা দেয়, তখন তা মাছের মায়ের পুত্রশোকের মতোই শোনায় বৈ কি! সেই কান্নায় সত্যিকার আবেগ নেই, রক্তে আগুন ধরানো সেই কথাগুলোতে নেই সত্যিকার প্রতিবাদের সুর। দিনশেষে তা কেবল জনপ্রিয়তা আর আখের গোছানোর মাধ্যম ছাড়া আর কী হবে? এমন এক নারী-চরিত্রকে মহান, মহীয়ান, মহানুভবতার রূপ দিতে হোসেন তাই ভীষণ অনীহ। হোসেন আর যা-ই হোক, নিজের সাথে অসৎ হতে পারবে না।
[সাত]
হেমন্তের দুপুর। দিনগুলো বড্ড ছোটো এ সময়। সকাল হওয়ার আগে যেন দুপুর হয়ে যায়, বিকেলের আগে নেমে যায় সন্ধ্যা। কিন্তু দুপুরবেলার রোদটা বেশ ঝাঁঝালো। সেই ঝাঁঝালো রোদে চামড়ায় আগুন ধরে যাওয়ার অবস্থা দাঁড়ায় কখনোসখনো।
এমন এক তীব্র দাবদাহের দুপুরে, পাট-পাতার বেড়া দিয়ে তৈরি রান্নাঘরে চুলোয় ভাত বসিয়েছেন জাহানারা বেগম। ভাতের মধ্যে একটা আলু আর কয়েকটা কাঁচামরিচ দেওয়া। ধোঁয়ায় চারদিক যেন অন্ধকার হয়ে উঠেছে।
নিঃশব্দে রান্নাঘরের কাছে এসে দাঁড়ালো হোসেন। সে দেখতে পেলো, ভীষণ মনোযোগের সাথে তার মা চুলোয় আগুন ধরাবার চেষ্টা করছেন। কেন জানি, আগুন জ্বলে উঠেও পরমুহূর্তে নিভে যাচ্ছে আবার। জাহানারা বেগমও দমে যান না, যতোবার নিভে যায় আগুন, ততোবার তিনি দ্বিগুণ প্রচেষ্টায় মুখর হয়ে ওঠেন।
যেভাবে নিঃশব্দে সেখানে এসে দাঁড়িয়েছিলো হোসেন, সেভাবেই সরে গেলো সে। তার হাতে সময় খুব কম। মহীয়সী গল্পটা তাকে লিখতেই হবে, যেভাবেই হোক।