হোসেন একটা নরম, শাদা সোফায় গিয়ে বসে। চারদিকের এতো এতো দামি জিনিসপত্রের মাঝখানে নিজেকে খুবই বেমানান আর অসহায় লাগে তার। ঘরটার যেখানেই চোখ পড়ছে, সেখানেই দৃষ্টি থতমত খেয়ে থমকে যেতে চাইছে।
‘সুপ্রভাত মিস্টার হোসেন’, একটা মেয়েলি কণ্ঠস্বর ভেসে এলো হোসেনের কানে। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে সে দেখে, জলপাই রঙের শাড়ি পরা এক মহিলা তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে হোসেনের মনোযোগ নিবিষ্ট ছিলো বলে মহিলার আগমন-বার্তা টের পায়নি সে।
বসা থেকে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে হোসেন বলে, ‘সুপ্রভাত।’
‘আপনিই তাহলে ভিনগ্রহী আগন্তুক গল্পটার লেখক! আমি তো ভেবেছিলাম বেশ বয়সটয়স হবে আপনার, কিন্তু আদিত্য সাহেবের কাছে আপনার ব্যাপারে শুনে অনেকটাই তাজ্জব হয়েছি বৈ কি! তা যা-ই হোক মিস্টার হোসেন, গল্পটা কিন্তু সুপার-ডুপার লেভেলের! কনগ্র্যাটস!
‘ধন্যবাদ।’
‘কী খাবেন? চা না কফি?’
‘চা।’
মিস সুলেখা গলা ছেড়ে বললেন, ‘রাজিয়া, অ্যাই রাজিয়া…।’
রাজিয়ার কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে তিনি হনহন করে হেঁটে চলে গেলেন ভেতরে। একটু পরে এসে বললেন, ‘দুঃখিত মিস্টার হোসেন, আপনাকে একা বসিয়ে রেখে গিয়েছিলাম।
‘না না, কোনো সমস্যা নেই।’
‘আপনি সম্ভবত আমার একটা ইন্টারভিউ নিতে এসেছেন, তাই না?’
‘ঠিক ইন্টারভিউ নয় আসলে। নয়াদিন পত্রিকা আমাকে একটা দায়িত্ব দিয়েছে। মহীয়সী শিরোনামে আমাকে একটা গল্প লিখতে হবে। ওই গল্পটার পটভূমিকায় থাকবেন মূলত আপনি। ধরে নিতে পারেন, আপনার জীবন এবং কাজকে ঘিরে আমাকে গল্পটা লিখতে হবে।’
‘ফাইন। আপনার মতো দুর্দান্ত গল্পকারের হাতে আমার বিনির্মাণ হবে জেনে পুলক অনুভব করছি।’
‘আমি কিন্তু বিখ্যাত কেউ নই।’
তবে বিখ্যাত হতে যাচ্ছেন। হা হা হা।’
‘মহীয়সী’ গল্পটা লিখবার রসদ সংগ্রহের নিমিত্তে মিস সুলেখা সাথীকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যায় হোসেন। রাজিয়া নামের সাত বা আট বছরের একটা মেয়ে চা নিয়ে এলে মিস সুলেখা তাকে বললেন, ‘উনাকে চায়ের কাপটা এগিয়ে দে।’
হোসেনের জন্য ট্রে থেকে চায়ের কাপ তুলতে গেলে চা সমেত কাপটা রাজিয়ার হাত থেকে উল্টে পড়ে যায়। টেবিলে থাকা একটা নোটপ্যাড চা লেগে ভিজে নাস্তানাবুদ হয় সাথে সাথে। এতোক্ষণ ধরে মিস সুলেখার সাথে আলাপের চুম্বকাংশ এই প্যাডে টুকে নিচ্ছিলো হোসেন। ঘটনাটায় রেগেমেগে আগুন হয়ে যান মিস সুলেখা। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তিনি বেসামাল হয়ে ওঠেন। রাজিয়ার গালে কষে একটা চড় লাগিয়ে দিয়ে বেশ তিরিক্ষি গলায় চেঁচিয়ে উঠে বলেন, ‘দূর হ আমার চোখের সামনে থেকে। আপদ কোথাকার! একটা কাজ ঠিকমতো করতে পারিস না!’
শান্ত পরিবেশে হঠাৎ কেমন যেন স্পষ্ট হতে লাগলো একটা অস্থিরতার ছাপ। ধমক খেয়ে রাজিয়া ভয়ে কাঁপতে শুরু করলো। ভয়ার্ত হরিণীর মতো তার চোখ দুটো বিহ্বল হয়ে উঠেছে। সে বুঝতে পারছে না কার কাছে ক্ষমা চাইবে। মিস সুলেখার কাছে, না হোসেনের কাছে।
নোটে টুকে নেওয়া লেখাগুলো ভিজে নষ্ট হওয়াতে হোসেন তেমন কষ্ট না পেলেও, বেচারি রাজিয়াকে এমন বেকায়দায় পড়তে দেখে তার মনটা হুহু করে উঠলো।
মিস সুলেখা অনুনয়ের সুরে হোসেনের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনার নোটপ্যাডটা নষ্টই হয়ে গেলো! কিছু মনে করবেন না মিস্টার হোসেন।
‘না না, এটা মোটেও সিরিয়াস ব্যাপার নয়। এগুলো আমার মনেই থাকবে সব। নোট করার একটা অভ্যাস আছে বলেই আসলে নোট করা।’
সোফায় বসতে বসতে সুলেখা সাথী বললেন, ‘আর বলবেন না! বাসায় একদল জন্তু-জানোয়ার পালছি আমি। কারও দ্বারা কোনো কাজ হয় না। একটা কাজ যদি এরা ভালোমতো করতে পারতো! কিন্তু অন্ন-ধ্বংসের বেলাতে সবাই একেবারে সোয়া সের!’
হোসেন নির্বিকার হয়ে বসে থাকে। এমন কোনো সাংঘাতিক ঘটনা এখানে ঘটেনি, যার জন্যে মিস সুলেখাকে এতোখানি উত্তেজিত হতে হবে। একটা বাচ্চা মেয়ের হাত থেকে চায়ের কাপ পড়ে যাওয়াটা আহামরি কোনো ব্যাপার নয়। আর, দামি দামি জিনিসপত্রে ভরপুর যার ঘর, একটা কাঁচের কাপ ভাঙাতে তার কী এমন ক্ষতি হয়ে গেলো বোঝা গেলো না। মিস সুলেখার এমন অকারণ রাগ এবং নিরীহ কাজের মেয়ের ওপরে এমন চড়াও মনোভাব হোসেনকে দারুণভাবে হতাশ করলো। এমন একটা চরিত্রকে সে ‘মহীয়সী’ গল্পের জন্য কোনোভাবেই কল্পনা করতে পারছে না।
‘মিস্টার হোসেন, মিস সুলেখার কণ্ঠে আবার স্নিগ্ধতা ফিরে আসে। সংবিৎ ফিরে পায় হোসেন।’
‘জি।’
‘আপনাকে আরেকটু কষ্ট দেবো। একটা জরুরি প্রোগ্রামে আমাকে যেতে হবে এখন। বেশি দূরে নয় যদিও, বেইলী রোডেই। আপনার যদি কোনো অসুবিধে না হয়, আমি না ফেরা পর্যন্ত আপনি এখানে একটু অপেক্ষা করবেন, প্লিজ।’
‘কোনো সমস্যা নেই। আমি অপেক্ষা করবো।’
‘থ্যাংকিউ মিস্টার হোসেন।’
[পাঁচ]
হোসেনের চোখ আটকে আছে ‘দূরবীন’ টিভির পর্দায়। তাতে ঘটা করে বেইলী রোডে অনুষ্ঠিত হওয়া ‘নারী অধিকার’ আন্দোলনের লাইভ প্রোগ্রাম দেখানো হচ্ছে। কোনো এক মহিলা গার্মেন্টস কর্মীর গায়ে হাত তোলায় গার্মেন্টস মালিকের ওপর ভীষণভাবে ক্ষিপ্ত হয়েছেন তারা। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আজকের এই প্রতিবাদী জনসভা, এবং তাতে অন্যতম প্রধান অতিথি হিশেবে যোগ দিয়েছেন নারী আন্দোলনের সুপরিচিত মুখ সুলেখা সাথী।