শোকের মাতমে জালাল মাস্টারের বাড়ি তখন আচ্ছন্ন। শোকে মুহ্যমান মানুষগুলোর চেহারায় ভর করেছে ঘন বিষাদের কুয়াশা। রোদের তীব্রতাও এই কুয়াশা কাটাতে পারে না। একখানা মাদুরে আলতো করে শহিদুল শুইয়ে দিলো তার কোলে থাকা নিথর শরীরটাকে। তারপর, আস্তে আস্তে অনাবৃত করলো তার চেহারা। যখন চাদরের আবরণ ভেদ করে প্রস্ফুটিত হলো সন্তানের অবয়ব, শহিদুল, আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। জমানো শোকের ভার আর সইতে পারল না সে। সন্তানের অনড় দেহটাকে বুকের সাথে জড়িয়ে নিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে তুলল সারা দেহ।
এখনো পাথর মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মিনু। মাদুরে শোয়ানো সন্তানের দিকে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ। চেহারায় নেমে এসেছে কালবোশেখির সমস্ত ঘন কালো মেঘ। তার অসহায় চাহনি, ব্যথাতুর চোখে সে যেন শেষ বারের মতন দেখে নিচ্ছে বুকের মানিককে।
‘রাক্ষসী!’ বিপুল জনতার স্রোতে একটা রব উঠেছে বটে! ও-বাড়ির আলেয়ার মা, যাকে সবাই রাঙা মা বলে ডাকে, তার মুখ থেকেই বেরিয়ে আসে এই শব্দ। মুহূর্তে জনতার সকল মনোযোগ, সকল আকর্ষণ যেন এই একটি শব্দকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতে শুরু করে। এ-কান ও-কান থেকে সাত-পাঁচ-দশ কান হয়ে গেলো। সবার তীক্ষ্ণ তীর্যক দৃষ্টি এসে পড়লো উঠোনের অন্য পাশে, জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বেচারি মিনুর ওপর।
ভিড় ঠেলে এগিয়ে এলো শহিদুলের মা। আলেয়ার মায়ের মুখোচ্চারিত শব্দটাকে দ্বিগুণ উৎসাহের সাথে লুফে নিয়ে, সেই শব্দটাকে পুনরায় বাতাসে গুঞ্জরিত করে দেওয়ার কাজটা খুব ভালোমতোই করতে পারলেন তিনি। আরও বহুগুণ শোকে যেন ভেঙে পড়লেন আলেয়ার মায়ের আঁচলে। কান্না আর ক্ষোভের দারুণ সংমিশ্রণে তিনি বলতে লাগলেন, ‘ঠিক কইছেন, বুজান। বউ নয়, এ সাক্ষাৎ রাক্ষসী। আমার ছেলেডার জীবনটারে তামা তামা কইরে দিলো এই পোড়ামুখী। আমার ছেলে, সংসার সব তছনছ কইরা দিলো গো, বু। আমার সব শেষ। শেষমেশ আমার নাতিডারেও খাইলো এই জল্লাদী।
অপলক তাকিয়ে আছে মিনু। কোন শোক সামাল দেবে সে? পুত্র-বিয়োগের শোকে কাতর হবে, নাকি অসহায় আর্তনাদে আর্তচিৎকার করে উঠবে তার দিকে ধেয়ে আসা অপবাদের অপমানে? মুহূর্তে এই অপবাদের সুর বাতাসের গতিতে হুড়মুড় করে ছড়িয়ে পড়লো বাড়িময়। সবার কাছে একটি ছোট্ট শিশুর মৃত্যু ঘটনার চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে শহিদুলের বউয়ের রাক্ষসী হয়ে ওঠার গল্পটাই। চারিদিক থেকে ভেসে আসতে লাগলো চি-চিৎকার! মহিলারা মুখে কাপড় দিয়ে বলছে, ‘রাক্ষসীই বটে! পুরুষেরা ধি-ধিক্কার করছে শহিদুলকে। এমন অপয়া, অলক্ষুণে মেয়ের সাথে কেন সে ঘর সংসার করছে, তা-ই উপস্থিত জনতা বুঝে কুলিয়ে উঠতে পারছে না।
কাহিনির নেপথ্য কারণ আরও পেছনে, আরও গভীরে। ছেলের বউ হিশেবে মিনু কখনোই শহিদুলের মায়ের পছন্দের তালিকায় থাকতে পারেনি। নেহাত শহিদুল এবং তার বাবার পছন্দের বলেই মিনু এ বাড়ির বউ হয়ে উঠতে পেরেছিল। কিন্তু মিনুর কপালের লিখন যে অন্য! যে সন্ধ্যায় শহিদুল মিনুকে ঘরে তুলে আনে, ঠিক ওই রাতেই শহিদুলের বাবা হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। একেবারে হঠাৎ মৃত্যু যাকে বলে! সে রাতেও বেশ কানাকানি, বেশ কথা চালাচালি হয়েছিলো কারও কারও মাঝে। ‘আইজকার দিনেই এমনডা ঘইটলো?’ বলে বিস্ময় প্রকাশ করেছিলো আশপাশের চাচি-জেঠিরা। সভ্যতার সম্ভাব্য সকল আলো থেকে দুরে, এমন। প্রত্যন্ত অঞ্চলের মাঝে এমন একটা ঘটনা থেকে যে নানান ডালপালা গজাবে, তা তো জানা কথাই। জালাল মাস্টারের বাড়িতেও–ই হলো। তবে শহিদুলের অপ্রতিরোধ্য ভালোবাসা, অপরিসীম প্রেম আর সুষম শিক্ষার কারণে সেদিন সেই গুঞ্জন খুব বেশি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু ঘটনার সেখানেই সরল সমাপ্তি ছিলো না। তাদের বিয়ের এক মাসের মধ্যে একটা দুধেল গাভি হঠাৎ বিকারে ধড়ফড়াতে ধড়ফড়াতে মারা গেলো। বর্ষার ভারী বর্ষণে সেবার শহিদুলদের চাষের দু-বিঘা জমি ফসল সমেত অথৈ পানির তলায় তলিয়ে গেলো। ঘটনা যখন এই, তখন কি আর পড়শিদের বুঝতে বাকি থাকে কিছু? সন্দেহের সকল সংঘবদ্ধ তির ধেয়ে এলো মিনুর দিকেই। ও মেয়েটাই অপয়া। ওর জন্যই এমন গেরস্ত ঘরের আজ এই দুর্গতি।
শহিদুল বাধ্য হয়ে মিনুকে শহরে তুলে আনে। মাকে কতো অনুনয়-বিনয় করেছিলো তার সাথে শহরে এসে থাকতে; কিন্তু তিনি রাজি হননি। স্বামীর রেখে যাওয়া ভিটে-মাটি ছেড়ে তিনি দূর প্রবাসে গিয়ে থাকবেন, এ তো স্বপ্নেরও অতীত। কল্পনারও বাইরে। অতএব, শহিদুল মিনুকে নিয়েই শহরে সংসার পেতেছিলো। ‘মিনু অপয়া’–এমন কুসংস্কারে শহিদুল কখনোই কর্ণপাত করেনি। ধর্মীয় শিক্ষা তার যথেষ্টই আছে। মিনুরও ধর্মীয় শিক্ষার কমতি নেই। তাই গ্রামের সরল মানুষের গরল ভাবনা তাদের দূরত্বের কারণ হয়ে উঠতে পারেনি কখনোই।
শহিদুলের মা মিনুকে উদ্দেশ্য করে বললো, ‘দ্যাখ দ্যাখ, রাক্ষসীর দিকে তাকায়ে দ্যাখ। এক ফোঁটা জল নাই চোক্ষে। এক ফোঁটা কান্দনের আলামত নাই। শ্বশুররে খাওনের পর নিজের পোলাডারেও খাইলো ডাইনিটা। ও আল্লাহ, তুমি আমার বাপটারে বাঁচাও। এই রাক্ষসীর কবল থেইকা তুমি আমাদের মুক্তি দাও গো, মাবুদ।