চুপ করে থাকে হোসেন। নীরবতাকেই সম্মতির লক্ষণ ধরে নিয়ে তিনি পুনরায় বলেন, না, নয়াদিন এমন কাঁচা কাজ কখনোই করবে না মিস্টার হোসেন। নয়াদিন বাংলাদেশের প্রসিদ্ধ কয়েকটা সাহিত্য-পত্রিকার মধ্যে অন্যতম। এমন একটা পত্রিকা কারও একটা লেখা পড়ে তাকে এতোবড়ো পদে এনে বসিয়ে দেবে, এমন দুর্মতি নয়াদিন কর্তৃপক্ষের হয়নি।
আলোচনাটা এবার জটিল থেকে জটিলতর হতে শুরু করেছে। আদি সাহেব কেবল দেখতেই সুদর্শন নন, গুছিয়ে কথা বলাতেও তিনি বেশ সিদ্ধহস্ত। শ্রোতাকে মুগ্ধ করে রাখবার একটা সম্মোহনী শক্তি আছে তার গলায়। নয়াদিন বেশ যোগ্য লোককেই বসিয়েছে তাদের সর্বোচ্চ পদে–হোসেন ভাবে।
‘মিস্টার হোসেন’, হোসেনের ভাবনায় ছেদ পড়লো আদি সাহেবের কথায়। আপনি সম্ভবত বুঝতে পারছেন যে, নয়াদিন পত্রিকা আপনাকে একটা দুর্দান্ত কাজের সুযোগ দিতে চায়, যা আপনার প্রতিভাকে বিকশিত করার কাজে সহায়ক হবে। তবে এর জন্যে আপনাকে আরও একটু পরিশ্রম করতে হবে।’
‘যেমন?’, জানতে চাইলো হোসেন।
খানিকটা নড়েচড়ে বসলেন আদি সাহেব। পাশে থাকা পানির বোতল থেকে ঢকঢক করে পানি গিলে নিয়ে বললেন, ‘সামনের নারী দিবসকে কেন্দ্র করে আমাদের একটা বড়ো প্রজেক্ট আছে। প্রজেক্টটির নাম মহীয়সী। আমাদের দেশে যারা নারীমুক্তির আন্দোলনে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন, তাদের জীবনকে তুলে ধরাই ওই প্রজেক্টটির মূল লক্ষ্য।’
‘কিন্তু আমার কাজ কী হবে এখানে?’
‘আপনার কাজ খুব সহজ, মিস্টার হোসেন। আপনার সত্তার সাথেও তা ভীষণভাবে যায়।’
‘দুঃখিত, আমি বুঝতে পারলাম না ঠিক।’
হো হো করে হেসে উঠলেন আদি সাহেব। হাসতে হাসতেই বললেন, ‘না বুঝতে পারাটাই স্বাভাবিক। আপনার জায়গায় আমি হলেও হয়তো বুঝতাম না। যাহোক, আর কোনো ভূমিকা নয়, আমরা সরাসরি কাজের কথায় ঢুকে পড়ি। আপনি যে ভালো গল্প লেখেন তা আপনার গল্পটা পড়েই আমরা নিশ্চিত হয়েছি। তবে, নয়াদিনে কাজ করতে হলে আমাদের জন্য আপনাকে আরও একটা গল্প লিখতে হবে। এবারের গল্পের প্লট আমরাই আপনাকে দিয়ে দেবো। এটাকে ঠিক প্লট বলা যায় না যদিও, বলতে পারেন কাহিনি-বিন্যাসের একটা প্রাথমিক সূত্র। আপনাকে সেই সূত্র ধরে আগাতে হবে এবং লিখতে হবে একটা পূর্ণাঙ্গ গল্প। ধরে নিতে পারেন, ওটাই আপনার কাজের ফাইনাল ইন্টারভিউ। ওটাতেও যদি আপনি নয়াদিনকে সন্তুষ্ট করতে পারেন, উই আর রেডি টু কনগ্রাচুলেট ইউ হিয়ার।’
স্বপ্নটাকে যতোটা সহজলভ্য মনে হয়েছিলো প্রথমে, সেটা আসলে ততোটা সহজ নয়। কিন্তু হোসেন দমে যাওয়ার পাত্র না। এতোদূর এসেও ব্যর্থ-মনোরথে ফিরে যাবে, তা হতে দেওয়া যায় না। আর, একটা গল্পই তো তারা চাইলো কেবল! গল্প। লিখতে হোসেনের ভালোই লাগে। ডায়েরিতে কতো কতো গল্প লিখে ড্রয়ারবন্দী করেছে সে! জোছনার গল্প, জোনাকি আর ঝিঁঝিপোকার গল্প, তারাদের গল্প, নীল আকাশের গল্প। কী নিয়ে গল্প লেখেনি সে?
‘ঠিক আছে। নয়াদিনের এই প্রস্তাবে আমি রাজি আছি’, মুহূর্ত বাদে আদি সাহেবের চোখের দিকে তাকিয়ে কথাটা বললো হোসেন।
‘ধন্যবাদ। আমি জানতাম আপনি দ্বিমত করবেন না। একজন জাত গল্পকার মানুষ গল্প লিখবার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতে পারেই না।’
আরও অনেক গল্প হয় দু’জনের মাঝে। হোসেনকে বুঝিয়ে দেওয়া হয় গল্প লিখবার প্রাথমিক সূত্রও। সুলেখা সাথী নামের একজন পরিচিত নিবেদিতপ্রাণ নারী আন্দোলন কর্মীকে ঘিরেই রচিত হবে ‘মহীয়সী নামের গল্পটি। কিন্তু যাকে ঘিরে রচিত হবে গল্প, তার সম্পর্কে তো হোসেনের জানা থাকা চাই। সে বন্দোবস্ত নয়াদিন পত্রিকা করে দেবে। মিস সুলেখা সাথীর বাসায় আগামীকাল এবং তার পরের দিন হোসেন যাবে এবং গল্পের জন্য যতোখানি তথ্যের রসদ দরকার, সবটা সুলেখা সাথীর মুখ থেকেই শুনে নেবে সে।
[চার]
বড়ো একটা অ্যাপার্টমেন্টের কাছে এসে দাঁড়ালো হোসেনের রিকশা। রিকশাওয়ালা তার গামছা দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললো, ‘নামেন মামা। এই বাসাডাই।’
হোসেন তার নোটবুকে টুকে আনা ঠিকানার সাথে মিলিয়ে নেয় একবার। হ্যাঁ, চলে এসেছে সে সঠিক জায়গায়। রিকশাভাড়া চুকিয়ে দিয়ে গেইটের কাছে আসতেই বুড়োমতো একজন লোক দৌড়ে এলো হোসেনের দিকে।
‘কী চাই?’
‘এটা তো মিস সুলেখা সাথীর বাসা, তাই না?’
‘জি।’
‘আমি সাপ্তাহিক নয়াদিন পত্রিকা থেকে এসেছি মিস সুলেখা সাথীর সাথে দেখা করতে।’
‘আপনার নাম?’
‘হোসেন।’
বয়স্ক ভদ্রলোক গেইট খুলে দিয়ে বললেন, ‘আসুন।’
হোসেন ভেতরে ঢুকতেই তিনি পুনরায় বললেন, ‘সোজা গিয়ে হাতের বামে লিফট। তিন নম্বর ফ্লোরে থাকেন সুলেখা ম্যাডাম।’
লোকটাকে হয়তো আগ থেকেই সব বলে দেওয়া ছিলো, তাই প্রবেশ-পথে কোনো বিড়ম্বনার শিকার হতে হলো না হোসেনকে। লিফটের কাছাকাছি যেতেই আরও একজন বয়স্ক মানুষের দেখা মিললো। তিনি নিজ থেকেই বললেন, ‘আপনার নাম কি হোসেন?’
‘জি।’
‘আমার সাথে আসুন, ম্যাডাম আপনাকে সাথে নিয়ে যেতে বলেছেন।’
এখানে সবকিছু এতো গোছালো দেখে নয়াদিন সম্পাদককে মনে মনে একটা ধন্যবাদ দিলো হোসেন। লোকটা সত্যিই কাজের মানুষ!
হোসেন কোনোদিন রাজপ্রাসাদ দেখেনি, কিন্তু মিস সুলেখা বেগমের বাসায় প্রবেশ করে হোসেনের মনে হলো, সে সত্যি সত্যি একটা অনিন্দ্য সুন্দর রাজপ্রাসাদে ঢুকে পড়েছে। কী অপূর্ব সুন্দর করে সাজানো চারদিক! দেয়ালে দেয়ালে শ্বেত পাথরের কারুকাজ। দেখলে মনে হয় যেন গভীর সমুদ্রতলের অপার সৌন্দর্য এখানে লেপ্টে দেওয়া হয়েছে। সেগুলোর আশেপাশে কতো বিচিত্র রঙের আল্পনা আঁকা! দামি পেইন্টিংয়ে ফুটে উঠেছে শহুরে আভিজাত্য! বহুমূল্য আসবাবের দিকে তাকালে ঘরটাকে পাঁচতারা হোটেল, আর দুর্লভ সংগ্রহে চোখ পড়লে রীতিমতো জাদুঘর না ভেবে উপায় থাকে না।