‘আপনাকে দেখে আমি কিন্তু বেশ অবাকই হয়েছি বলা চলে।’
তাকে দেখে অবাক হওয়ার কী কারণ থাকতে পারে সেটা হোসেন বুঝতে পারলো না। তবে কী তার কোনো আচরণ খুবই অপ্রত্যাশিত ঠেকেছে আদি সাহেবের কাছে? হোসেন অস্বস্তিবোধ করছে বুঝতে পেরে আদি সাহেব বললেন, ‘তেমন কিছু না। আসলে আপনার গল্পটা পড়ে আমি এতোখানি মুগ্ধ হয়েছি, আমার ধারণা ছিলো আপনি হয়তো কোনো বয়স্ক লোকটোক হবেন। কিন্তু আপনি দেখছি একেবারে তাগড়া জোয়ান! হা হা হা। আমি যতোখানি অবাক হয়েছি, খুশি হয়েছি তারচে বেশি। আমাদের আজকালকার তরুণদের লেখার মাঝে প্রাণ পাই না কেমন যেন! কেমন যেন খাপছাড়া, অগোছালো ধরনের। আর সবাই তো সম্মিলিতভাবে একই ধারার গল্প-উপন্যাস লিখবার পণ করেছে বলা যায় একপ্রকার। তরুণদের নিয়ে আমার এই নিরাশার সময়ে আপনার মতো একজন তরুণের আবির্ভাব দুঃখের গহ্বর থেকে আমাকে অনেকটাই টেনে তুলেছে। তরুণরা এখনো যে অসাধারণত্ব উপহার দিতে পারে–মিইয়ে যাওয়া আমার সেই বিশ্বাসের পুনর্জাগরণ হলো আপনাকে দেখে।’
আজ হোসেনের বারবার বিস্মিত হবার দিন। এতোটা মূল্যায়ন সে স্বপ্নেও আশা করেনি। সেই প্রথম চিঠিপ্রাপ্তির দিন থেকে আজ অবধি সে যেন এক নিঃসীম স্বপ্নলোকের যাত্রী হয়ে চলেছে।
কফি চলে এলে আদি সাহেব হোসেনকে কফি নেওয়ার অনুরোধ করেন। কফিতে চুমুক দিতে দিতে তিনি বললেন, ‘আমার দুর্ভাগ্য যে আপনাকে আমি এতো দেরিতে আবিষ্কার করলাম। আগে কোন কোন পত্রিকায় লিখেছেন আপনি?
হোসেন সলজ্জ চেহারায় বললো, ‘আসলে, আমি এর আগে অন্য কোথাও লিখিনি কখনো।’
চোখজোড়া কপালে উঠে গেলো নয়াদিন সম্পাদকের। দৃষ্টি যে তার কোন দিগন্তে গিয়ে স্থির হয়ে গেলো তা বোঝা গেলো না। তার বিশ্বাস হচ্ছে না যে, হোসেন এর আগে অন্য কোথাও লেখালেখি করেনি। তিনি বিস্ময় জড়ানো কণ্ঠে বললেন, ‘মাই গুডনেস! আপনি এর আগে কোথাও লেখেননি?’
‘জি না।’
‘আই সি! আপনি তো আস্ত একটা আশ্চর্য মানুষ ভাই! মানে সত্যি বলছি, আমার এখন মনে হচ্ছে, আপনার ভিনগ্রহী আগন্তুক গল্পটার চরিত্রের মতো আপনিও অন্যকোনো গ্রহ থেকে টুস করে এখানে এসে পড়েছেন! আই অ্যাম টোটালি এস্টোনিশড!’
হোসেন নির্বাক, মুগ্ধ শ্রোতা হয়ে শুনে যায় নয়াদিন সম্পাদকের কথা।
‘তার মানে, নয়াদিনেই আপনার প্রথম লেখা ছাপা হয়েছে?’
‘জি৷’
‘অ্যামেইজিং!’ সম্মুখে উপবিষ্ট নয়াদিন সম্পাদকের চোখেমুখে গভীর উত্তেজনার ছাপ। হাজারো মানুষের কাছে যা স্বপ্নেরও অতীত, আপনার জীবনে তা সহজ বাস্তবতা! You are so lucky Mr. Hossen, and we are lucky as well to have the chance to discover a merit like you’.
কথা-আড্ডায় বিস্ময়-পর্ব পার হয়ে যায়, বেলা গড়িয়ে তখন সন্ধ্যা হয় হয় অবস্থা। হোসেন বললো, ‘নয়াদিন পত্রিকা এবং তাদের বদান্যতার কথা অনেকদিন মনে থাকবে আমার। স্মৃতিটুকু জীবনের আনন্দ হিশেবে জমা রেখে দেবো।’
হোসেনের কথার সুরে বিদায়ের আভাস পেয়ে আদি সাহেব বললেন, কিন্তু মিস্টার হোসেন, নয়াদিন তো আপনার সাথে সেই আনন্দ-স্মৃতিকে অনেকদূর পর্যন্ত বিস্তৃত করতে চায়।
ধড়ফড় করে ওঠে হোসেনের বুক। মনে হলো সেই আকাঙ্ক্ষিত মুহূর্তের একেবারে সন্নিকটে দাঁড়িয়ে হোসেন। হাত বাড়ালেই ছুঁতে পাবে স্বপ্ন, যে স্বপ্ন আকাশের নীলের মতোই অসীম, ঝরনার জলের মতোই নিঝর। কিন্তু হোসেন হাত বাড়ায়, নয়াদিনের বাড়ানো হাতকে স্পর্শ করে স্বপ্নের দুনিয়ায় পদার্পণ করাই তার ইচ্ছে।
‘আপনি সম্ভবত বুঝতে পারেননি। যাহোক, খোলাসা করেই বলা যাক। আপনার ভিনগ্রহী আগন্তুক গল্পটা পড়ে আমরা, মানে নয়াদিন পরিবার সত্যিকার অর্থেই বিমোহিত হয়েছি। এমন চমৎকার বর্ণনাশৈলীতে ভরপুর এতো দুর্দান্ত গল্পের দেখা হররোজ মেলে না। আমরা বেশ অনেকদিন থেকে একজন সম্পাদকের খোঁজে আছি, যিনি নয়াদিনের একটা বিরাট অংশের দায়িত্ব নিতে সক্ষম। দায়িত্বটা পুরোপুরি লেখালেখি-নির্ভর। যোগ্যতা হিশেবে তাকে অবশ্যই সৃজনশীল চিন্তার অধিকারী এবং ভালো লিখিয়ে হতে হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, অনেক খুঁজেঠুজেও আমরা এমন কাউকে পাইনি, যার ওপর নয়াদিন নির্ভয়ে নির্ভর করতে পারে। গড়পড়তা ভালো লেখা তো অনেকেই লেখে মিস্টার হোসেন, কিন্তু সম্পাদকের টেবিলে থাকা আমাদের মতো মানুষগুলোই জানে ওসব লেখার কতোখানি সত্যিকার লেখা হয়ে ওঠে। কিন্তু আপনার গল্পটা পড়বার পর থেকেই আমার মনে হয়েছে, ইউ আর দ্য পারসন উই আর লুকিং ফর। আপনাকে নিয়ে আমাদের এখানে দু-দফা বৈঠক হয়েছে। আপনার গল্পটার শক্তির জায়গা, কাহিনি-বিন্যাসে আপনার মুনশিয়ানা এবং গল্পের ভাষা নির্মাণে আপনার যে শিল্প-মন, তার সবিস্তার ব্যাখ্যা আমি সকলের কাছে পরিষ্কার করেছি। আপনার লেখাটাকে আতশ কাঁচের নিচে অনেক যাচাই-বাছাই করার পরেই কিন্তু আপনাকে চায়ের নিমন্ত্রণ জানিয়ে পত্র লেখা হয়েছে।’
‘কিন্তু…’
হোসেনকে থামিয়ে দেন নয়াদিন সম্পাদক। স্মিত হেসে তিনি বলেন, আমি জানি আপনি এখন কী বলবেন। আপনার একটামাত্র গল্প পড়ে নয়াদিনের মতো এমন তুখোড় জনপ্রিয় একটা পত্রিকা এই উপসংহারে কীভাবে আসতে পারে যে, আপনি এই কাজের উপযুক্ত, তাই তো?’