জাহানারা বেগম অস্ফুট স্বরে বললেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ! সম্মান দেওয়ার মালিক কেবলই আল্লাহ। তো, তুই কি আনন্দে আত্মহারা হয়ে ঘুমোতে পারছিস না বাবা?’
‘তা যা বলেছো তুমি, মা। আনন্দে আত্মহারা! হা হা হা। একদম ঠিক। আনন্দে আত্মহারা হয়ে আছি বলেই আমার চোখ থেকে ঘুম উধাও হয়ে গেছে। আমার মনে হয় কি জানো, আজ রাতে পৃথিবীতে আমি ছাড়া আর কারও মনে আনন্দ নেই, আর কারও জীবনে আনন্দের কোনো উপলক্ষ্য নেই। পৃথিবীর সব আনন্দ, সব রং আজ কেবল আমার জন্যেই বরাদ্দ।’
ছেলের আনন্দ দেখে জাহানারা বেগমের চোখে পানি এসে যায়। বাপ-মরা ছেলেটা কতো দ্রুতই-না বড় হয়ে গেলো তার। হোসেনের বেড়ে ওঠার পেছনে জাহানারা বেগমের যে সংগ্রাম আর সংযমের গল্প আছে, সেই গল্পটা তার গল্প-লিখিয়ে ছেলে লিখবে কোনোদিন? আজ তার নাম-ডাক চারদিকে, যখন সে অনেক বড় হবে, তখন কি সে তার বুড়ো মা’কে, যে নিজের সবটা দিয়ে তাকে আগলে রেখেছিল শতো ঝড়-ঝঞ্ঝাটে, মনে রাখবে? না রাখলেও কীই বা হবে? প্রাপ্তির আশায় বাবা-মায়েরা সন্তান মানুষ করে না। বাবা-মায়ের ভালোবাসাগুলো হয় নিঃস্বার্থ, নির্লোভ আর নির্ঝঞ্ঝাট।
ঘরে একটা চাপা স্তব্ধতা নেমে এলো। কিছুক্ষণ কারও মুখে কোনো কথা নেই। জাহানারা বেগম ছেলের মাথায় হাত বুলাচ্ছেন পরম মমতায়।
নীরবতা ভেঙে হোসেন বললো, ‘আচ্ছা মা, তুমি কেন জেগে আছো এখনো?’
স্মিত হেসে জাহানারা বেগম বললেন, ‘ছেলের আনন্দের দিনে মায়েরও তো আনন্দ হয়, তাই না বাবা?’
‘তা হয়, কিন্তু…’ জায়নামাযের দিকে তাকিয়ে হোসেন জিগ্যেশ করলো, ‘তুমি এতো রাতে সালাত পড়ছিলে?’
‘হ্যাঁ, তোর জন্যে দুআ করছিলাম আল্লাহর কাছে।’
‘বেশ তো। কী বলছিলে আল্লাহকে?’
‘বলছিলাম আগামীকাল তুই যে উদ্দেশ্যে যাচ্ছিস, তাতে যদি তোর জন্যে কল্যাণ থাকে, তবেই যেন তোর ওখানে মন টিকে। যদি তোর জন্যে কল্যাণ না থাকে, তবে তোর মনটাকে যেন আল্লাহ ওখান থেকে ফিরিয়ে দেন।’
জাহানারা বেগমের অদ্ভুতুড়ে দুআর কথা শুনে মনে মনে হাসলো হোসেন। সে ভাবে, ‘আমার আবার ওখানে মন টিকবে না! কতো আরাধ্য সে জগৎ! কতো দীর্ঘ রজনী তপস্যা করলে ও জগতে ঠাঁই পাওয়া যায়! এমন স্বপ্ন আর সৌভাগ্যকে পায়ে ঠেলবে–এতোটা আহাম্মক হোসেন নয়।’
[তিন]
‘কাকে চাই?’, দারোয়ান মতো একজন একপ্রকার তেড়ে এসে প্রশ্নটা করলো হোসেনকে।
‘আমি নয়াদিনের সম্পাদক আদিত্য আদি সাহেবের সাথে দেখা করতে এসেছি।’
‘কী নাম?’’
‘মোহাম্মদ হোসেন।’
‘ওই যে বেঞিটা দেখছেন, চুপচাপ ওখানে গিয়ে বসে পড়ুন। ভেতর থেকে ডাক আসলে আমি বলব,’ শাসনের সুরেই কথাগুলো বললো লোকটা। বলে অবশ্য বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারলো না। নতুন আরেক আম-আদমির আগমন দেখে ওদিকেই ছুট লাগাতে হলো তাকে। তাকেও প্রশ্ন করলো, ‘কাকে চাই?’
লোকটার কাঁচুমাচু উত্তরে সন্তুষ্ট হতে না পেরে তাকেও আগের বেঞিটা দেখিয়ে দিয়ে অপেক্ষা করতে বলা হলো।
খানিক বাদে একপ্রকার ছুটে এলো সেই লোকটা।
‘আপনাদের মধ্যে হোসেন কে?’
হোসেন দাঁড়িয়ে বললো, ‘আমি।’
এবারে দারোয়ান লোকটার চেহারায় কোনো রূঢ়তা লক্ষ করা গেলো না; বরং তার বদলে রয়েছে সীমাহীন শ্রদ্ধা আর আনুগত্যের ছাপ। কণ্ঠেও নেই খানিক আগের সেই কাঠিন্য।
‘দুঃখিত স্যার, আপনাকে এতোক্ষণ বসে থাকতে হলো। আদি স্যার আপনাকে ভেতরে নিয়ে যেতে বললেন।’
মুহূর্তের ব্যবধানে একই লোকের দু’রকম আচরণে খানিকটা ঘাবড়ে গেলো হোসেন। মানুষটার চোখেও এখন লজ্জা আর অনুশোচনার আবহ দেখা যাচ্ছে।
‘কোনো সমস্যা নেই। অপেক্ষা করতে আমার ভালোই লাগে।’
জগতের কারও কারও কাছে অপেক্ষা জিনিসটা যে সত্যিই উপভোগের–তা বোঝা নয়াদিন অফিসের এই দারোয়ানের সাধ্যের বাইরে। সুতরাং, হোসেনের কথাটা তার কাছে দরকারি বিনয় এবং একপ্রকার অদরকারি ভণিতা বলেই মনে হলো। ফলে, ঠোঁটের কোণে একটা মিথ্যে হাসি আনবার ব্যর্থ প্রচেষ্টার মাঝে যা স্পষ্ট হয়ে ধরা দিলো তা হলো এই–হোসেনের কথায় লোকটা একটুও পুলকিত হতে পারেনি।
‘আসুন আসুন, মিস্টার হোসেন। আপনার সাথে দেখা করবার জন্যে অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে আছি।’ কথাগুলো বলতে বলতে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন এক সুদর্শন ভদ্রলোক। তার সৌম্য-শান্ত চেহারার মাঝে সত্যিকার আনন্দের ঝিলিক দোল খাচ্ছে। তার চোখের দৃষ্টিতে ভণিতা-বিহীন অপেক্ষার অবসানের আবহ। নাহ, ভুল জায়গায় এসে পড়েনি হোসেন।
একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে হোসেন বললো, ‘ধন্যবাদ।’
‘কী খাবেন বলুন? চা না কফি?’
‘যেকোনো একটা কিছু হলেই হবে। না হলেও সমস্যা নেই কিন্তু।’
‘মাই প্লেজার! কিছু একটা তো হওয়া চাই-ই, তা নাহলে যে আমার নিমন্ত্রণপত্রের যথার্থতা বজায় থাকলো না। আমরা তো ধোঁয়া ওঠা কাপ হাতে নিয়ে আড্ডায় মেতে উঠবার শর্তে আবদ্ধ। হা হা হা।’
এতোখানি বিগলিত বিনয়ে হোসেন সত্যিই মুগ্ধ হলো। সে বসে আছে দেশের অন্যতম প্রধান সাপ্তাহিক পত্রিকা নয়াদিন সম্পাদকের সামনে। বাইরে আরও কতো মানুষ উন্মুখ হয়ে আছে তার সাথে একটু দেখা করার জন্যে। সেই মানুষটা চিঠিতে লেখা নিতান্ত অনুল্লেখযোগ্য কথাটাও মনে রেখে দিয়েছেন ভেবে যারপরনাই অভিভূত হলো হোসেন।
ফোন করে দু-কাপ কফির কথা বলে হোসেনের দিকে তাকালেন আদি সাহেব। মুখে তার সহজাত স্মিত হাসি।