ধন্যবাদান্তে
আদিত্য আদি
সম্পাদক, সাপ্তাহিক নয়াদিন।
হোসেন যেন এক ঘোর-লাগা সময়ের আবেষ্টনীর মাঝে বন্দী হয়ে পড়েছে। তার উদাসী, উচ্ছন্নে যাওয়া সময়গুলো এভাবে প্রাণ ফিরে পাবে, এভাবে সেগুলো চাঞ্চল্যে ভরে যাবে তা এখনো হোসেনের কাছে রূপকথার মতো মনে হয়।
হোসেনের প্রকাশ-ব্যাকুল আনন্দ ছুঁয়ে গেছে তার আড়ার বন্ধুদেরও। ঠোঁটকাটা শাওন ব্যগ্র কণ্ঠে বললো, ‘যা বলেছিলাম তা-ই হলো। হোসেন মিয়া এখন তারকাখ্যাতির পথে আরও একধাপ আগাইয়া গেলো। নয়াদিনের সম্পাদক চিঠি লিখে চায়ের নিমন্ত্রণ দেয়! উহ, কী সৌভাগ্য তোের! বড় হয়ে আমাদের ভুলে যাসনে বন্ধু।’
হোসেন বললো, কিন্তু, আদিত্য আদি সাহেব কী উদ্দেশ্যে আমাকে নিমন্ত্রণ জানালেন তা পরিষ্কার বোঝা গেলো না। তোর কী মনে হয় মিজান?’
মিজান তার স্বভাবসুলভ গাম্ভীর্য চেহারায় আরও প্রকট করে, শার্টের কোনা দিয়ে চশমার কাঁচ পরিষ্কার করতে করতে বললো, ‘একদম সহজ। এরা বিনা উদ্দেশ্যে খাতির জমাতে কাউকে ডেকে নেয় না। ওদের সময়গুলোও অতো সস্তা নয়। কিছু একটা উদ্দেশ্য তো আলবৎ আছে। আমি মনে হয় বুঝতে পারছি কিছুটা।’
মিজানের পর্যবেক্ষণের ওপরে সকলের গভীর আস্থা আছে। মিজান কোনো বিষয়ে কোনো মন্তব্য করবে, কিন্তু তার পেছনে যথেষ্ট যুক্তি, যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত থাকবে না, তা কখনো হতে দেখা যায়নি। শাওন তাকে যতোই হেসে উড়িয়ে দিক, মনে মনে সকলে, এমনকি শাওনও মিজানের পর্যবেক্ষণলব্ধ উপলব্ধি এবং মতামতকে শ্রদ্ধা করে।
‘বুঝতেই যখন পারছিস, পেটের ভেতরে আটকে রেখেছিস কেন? বলে ফেল না শুনি।’ শশব্যস্ত হয়ে মিজানের দিকে তীক্ষ্ণ কথার বাণ ছুঁড়ে দিলো ধৈর্যহারা প্রকৃতির শাওন।
শাওনের এই প্রকৃতির সাথে সবাই পরিচিত বলে ওর এমন চাঁছাছোলা কটাক্ষ আর তীর্যক মন্তব্যে কেউ তেমন গা করে না।
‘আমার ধারণা, ওরা হোসেনকে পত্রিকার কাজে নিয়োগ দিতে চায়। হতে পারে হোসেনের অনবদ্য গল্পটা পড়ে তাদের ধারণা হয়েছে, এমন ধাঁচের গল্প যে লিখতে পারে, তাকে দিয়ে অনায়েশেই পত্রিকার ব্যাপক কাজ করানো যাবে। নয়তো একজন নবীন লেখককে এতোবড়ো একটা পত্রিকার সম্পাদক যেচে নিমন্ত্রণপত্র পাঠাবেন, এটা কল্পনাতীত। এটা গুরুজী রবীন্দ্রনাথ, উস্তাদজী মুজতবা আলীর বেলাতেও ঘটেনি।’ বললো মিজান।
‘কাজকর্ম বলতে? কেমন ধারার কাজকর্ম?’ পাশ থেকে জিগ্যেশ করলো হাবিব।
‘তোরা আবার ভাবিস না যেন হোসেনকে চা আনা-নেওয়ার কাজে যোগ দিতে বলবে ওরা। প্রতিভার মূল্যায়নে এতোটা কৃপণ ওরা নয়। যোগ্য লোক পেলে ওরা মাটিতেও কামড় দেয়। কাজ বলতে আমি বোঝাতে চেয়েছি, এই যেমন ধর পত্রিকার জন্য ফিচার লেখা, বিশেষ সংখ্যাগুলোর জন্য গল্প লেখা, দরকার হলে মাঝেমধ্যে। অন্যদের লেখায় কলম চালানো। এই আর কী!’
‘তা তো বেশ ভালো কাজ তাহলে। এটা হলে আমাদের হোসেন মিয়ার তো কপাল খুলে যায়। হে হে হে।’ মুখরা শাওনের পুনঃরসিকতা।
[দুই]
কাজ? নয়াদিন পত্রিকায় কাজ করবে হোসেন? যে পত্রিকায় লেখা প্রকাশ করার জন্যে কতো ডাকাবুকো লেখকেরা দিনের পর দিন, রাতের পর রাত অপেক্ষা করে থাকে, সেই পত্রিকার একজন হয়ে উঠবে হোসেন? সত্যিই কি আদিত্য সাহেবের মনে এমন কোনো অভিপ্রায় আছে হোসেনকে ঘিরে?
এমন ঘোর-লাগা সময়ে আসলে ঘুমোনো যায় না। হোসেনেরও ঘুমোনোর তাড়া নেই। মানুষের জীবনে এ রকম রাত খুব বেশি আসে না। যখন আসে, তখন। সেগুলোকে উপভোগ করে কাটাতে হয়। সময়টাকে উপভোগ করতে গিয়েই হোসেনের চোখ থেকে ঘুম পালিয়েছে।
এমন হিমধরা হেমন্ত-নিশীথে ধরণির বুকে আর কেউ বুঝি জেগে নেই একা হোসেন ছাড়া। আজ রাতে আর কারও জীবনে কী আনন্দের কোনো উপলক্ষ্য আসেনি, যা তার চোখের ঘুম কেড়ে নেবে? যা তাকে ভাসিয়ে দেবে অনাবিল আনন্দস্রোতে?
হোসেনের ভাবনায় ছেদ পড়ে। পাশের ঘর থেকে কাশির শব্দ শোনা গেলো মাত্র। গায়ে শাল জড়িয়ে হোসেন এস্তপায়ে শব্দটার অকুস্থলের দিকে হেঁটে গেলো।
আলতো করে ভিজে দেওয়া ঘরের কপাট। নিস্তেজ হয়ে আসা একটা মোমের শরীর থেকে বিচ্ছুরিত মৃদু আলো ঘরটাকে রহস্যময় করে তুলেছে। ওই আলোতে এক নারী ছায়ামূর্তি হোসেনের দৃষ্টিগোচর হয়। জায়নামাযে বসে আছেন হোসেনের মা জাহানারা বেগম। হোসেন দরজায় ঠকঠক শব্দ করে দু’বার।
‘হোসেন?’ মৃদু গলায় জিগ্যেশ করেন জাহানারা বেগম।
‘হ্যাঁ মা, আমি। তুমি জেগে আছো?’
‘হ্যাঁ বাবা। ভেতরে আয়।’
হোসেন ভেতরে এলো। জাহানারা বেগম মোমবাতির প্রায় নিভে যাওয়া আগুন থেকে একটা কুপিবাতি ধরালেন। এতোক্ষণের আলো-আঁধারি ভাবটা কেটে গিয়ে ঘরময় এখন সফেদ আলোর ছড়াছড়ি।
‘ঘুমাসনি কেন?’, পুনরায় জিগ্যেশ করেন জাহানারা বেগম।
‘ঘুম আসছিল না।’
‘ভোরের ট্রেন ধরা লাগবে তা ভুলে গেলি, বাবা?’
‘কই, ভুলিনি তো।’
‘ভুলে না গেলে তো ঘুমানোর কথা। ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখ নিয়ে ট্রেন ধরা যায়?’
‘ও তুমি ভেবো না তো মা। ভাবছি আর ঘুমাবো না আজ। কটা বাজে এখন? তিনটে! রাত তো শেষ হয়ে এলো প্রায়। আর ঘুমিয়ে কাজ নেই।’
জাহানারা বেগম খাটে উঠে বসেন। হোসেন মায়ের কোলে মাথা রেখে বললো, ‘জানো মা, আগামীকালের দিনটা আমার জীবনের পরম আকাঙ্ক্ষিত একটা দিন হয়তো। ওই যে পত্রিকাটার কথা তোমায় বললাম, পুরো দেশে ওদের বেশ নামডাক। যার-তার লেখা ওরা ছাপায় না। বাঘা বাঘা লেখকেরাও ওই পত্রিকায় জায়গা পেতে হিমশিম খায়। সেই তারাই আমার লেখাটা বেশ উৎসাহের সাথে ছাপালো। শুধু কি তা-ই? ভালো অঙ্কের সম্মানি তো দিলোই, সাথে তাদের অফিসে চায়ের দাওয়াত। ভাবো তাহলে কেমন কদর পেয়েছি আমি!’