কথা শুরু করে শাদু মিয়া। এই ঘন গহিন অরণ্যের মাঝে, যেখানে বন্য জন্তুরাও বেঘোর ঘুমে অচেতন, সেখানে কতোক্ষণই বা আর চুপচাপ পথ চলা যায়? অন্তত শাদু মিয়ার মতন মুখরা মানুষের পক্ষে এতোক্ষণ মুখ বন্ধ করে রাখা সম্ভব নয়।
‘তা ভাইজান, পোলাডা মরলো কেমন কইরা?’
মরে গেছে? সংবিৎ ফিরে পায় শহিদুল। সত্যিই মরে গেছে? তার ফুটফুটে আদরের সন্তান, যার মাত্র চার মাস হলো বয়স, সে কি মরে গেছে? তুলতুলে হাতখানা ধরে কতো আদরই না করতো শহিদুল! দেখতে ভারি সুন্দর হয়েছিলো ছেলেটা! সেদিন ডাক্তার বললো, আপনার ছেলের বয়স কতো?
‘চার মাস’, অস্ফুটে জবাব দিয়েছিলো শহিদুল।
ডাক্তার যেন বিশ্বাস করলো না তার কথা। মুখ তুলে, চশমার পাতলা কাঁচের ভেতর দিয়ে ভালো করে আরেকবার দেখল বাচ্চাটাকে। এরপর বললো, ‘বাচ্চার ডেভলপমেন্ট তো খুবই ভালো। দেখে মনে হচ্ছে এক বছর বয়স।
অমন আদুরে চেহারা ছিলো যে, কেউ কোলে না নিয়ে থাকতে পারতো না। তুলতুলে শরীর। সবটা ছাড়িয়ে, তার মুখের হাসিটা ছিলো ভুবনভোলানো। চোখে চোখ রেখে, মুখখানা খানিক বাঁকিয়ে যখন সে হাসতো, শহিদুলের মনে হতো, জগতের সকল সরলতা, মুগ্ধতা আর বিস্ময় যেন তার চেহারায় এসে মাখামাখি। করছে। তার নিটোল চাহনির দিকে তাকিয়ে নিশ্চিন্তে কাটিয়ে দেওয়া যায় একটা মানবজনম। কিন্তু, একেবারে হঠাৎ করে, সেদিন প্রচণ্ড জ্বর উঠলো তার। চোখমুখ ফুলে বিপন্ন অবস্থা। ডাক্তার জানাল তার আমাশয় হয়ে গেছে। সাধারণ আমাশয় নয়, রক্ত আমাশয়। কতো যত্ন-খেয়াল, কতো আদর আর আলিঙ্গনের কাড়াকাড়ি তার মাঝেও ছেলেটার এমন একটা রোগ হয়ে গেলো? তারপর, তারপর একদিন অকস্মাৎ, একেবারে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে শরীরে খিচুনি এসে কাহিল করে দিলো তাকে। হাসপাতালে যখন নিয়ে যাওয়া হয়, ততোক্ষণে সে আর বেঁচে নেই।
বেঁচে নেই! কতো সহজেই হয়ে গেলো বলা! অথচ, শহিদুলের কাছে সে ছিলো তারা ঝলমলে এক পৃথিবী। যেদিন তার জন্ম হয়, যে ভোরবেলায়, কতো কাণ্ডই না সেদিন করেছিলো শহিদুল। তার পাগলামোতে হাসপাতালের সকলে অতিষ্ঠ হয়ে যায়। কেউ কেউ বলেছিলো, ‘পাগল! হ্যাঁ, পাগলই তো। কতো বছর, ঠিক কতো বছর পরে শহিদুলের ঘর আলো করে এই রত্নখানি এসেছে, তা কি এই মানুষগুলো জানে? আল্লাহর কাছে কতো করজোড় মিনতি, কতো আকুল প্রার্থনা, ব্যাকুল আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ এই ফল, তা কি কেউ বুঝবে?
হেলেদুলে এগিয়ে চলছে শাদু মিয়ার বলদ-গাড়ি। শহিদুল নিরুত্তর। শাদু মিয়া শহিদুলের মনের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করে। তার বুকের ভেতর কালবোশেখির যে তাণ্ডব বয়ে যাচ্ছে–সেটা শাদু মিয়ার অজানা নয়। সন্তান হারানোর শোকের সাথে শাদু মিয়াও সবিশেষ পরিচিত। তার ছোটো মেয়ে পারুল, সবে হাঁটতে শিখেছিল কেবল। এক দুপুরে, কোন ফাঁকে যে সে পুকুরতলায় চলে গিয়েছিল, তা আজও রহস্য। অতটুকুন মেয়ে, গুটিগুটি পায়ে অতটুকু পথ পাড়ি দিয়ে সোজা পুকুরে গিয়ে পড়বে আর সারাবাড়ির কেউ তাকে একটিবারের জন্যও দেখবে না–তা কি কম আশ্চর্যের ব্যাপার! সারাদিন খুঁজে খুঁটেও পারুলের হদিস মিললো না। পরে, সন্ধ্যের আগে আগে আস্ত পারুল ভেসে উঠলো পুকুরের মাঝে। পারুলের মৃত্যু নিয়ে অনেক জল্পনা-কল্পনা, অনেক লোক-গল্পের অবতারণা হয় মানুষের মুখে মুখে। সময় গড়িয়ে যায়, কেবল নেভে না শাদু মিয়ার বুকের দহন। ছোট্ট পারুলের সোনাবরণ চাহনিটা যেন আজও সমস্ত সৌন্দর্য, সমস্ত ঐশ্বর্য নিয়ে শাদু মিয়ার চোখের সামনে ভাস্বর হয়ে আছে। অতএব, শাদু মিয়া বোঝে সন্তানহারা পিতৃহৃদয়ের যাতনা।
যাত্রী হিশেবে শহিদুলের সাথে আরও একজন আছে। মিনু; শহিদুলের স্ত্রী। সেও নিরুত্তর। নিষ্পলক। তার চোখের দৃষ্টি কোথায়, কোন দিগন্তে গিয়ে যে স্থির হয়ে গেলো, তা কেউ জানে না। যে জঠর ভেদ করে একদিন এসেছিল প্রাণের ফোয়ারা, সেই ফোয়ারা আজ ফুরিয়ে গেছে। নিঃশেষে মিলিয়ে গেছে শূন্য দিগন্তে। মিনুর বুক ফেটে কান্না আসে, কিন্তু সে কাঁদতে পারে না। অশুরাও আজ পলাতক চোখ থেকে। নিদারুণ অবসাদে ভেঙে আসে শরীর, বিপন্ন বিষাদে ক্ষতবিক্ষত সে, কাতর আর্তনাদে গুঙিয়ে ওঠে মন, তবু আজ যেন কাঁদতে মানা। আজ কি কাঁদবার দিন?
পাথরের মূর্তির মতন বসে থাকে সেও। জোছনা রাঙানো রাতের আকাশ, বুনো ফুলের মনোহর গন্ধ, মাঝে মাঝে ডাহুকের ডাক–এ সবকিছু জুড়ে মিনুর কতো মুগ্ধতা! কিন্তু, শোক আর শখের লড়াইয়ে আজ শোকটাই জয়ী। এই তারাভরা রাত, অরণ্যের অসামান্য সৌন্দর্য–কোনোকিছুতেই আজ মিনুর মুগ্ধতা নেই।
তখন আকাশ ধবধবে ফর্সা হয়ে গেছে। ভোরের সোনারঙা রোদ এসে পাতায় পাতায় জাগিয়ে তুলেছে শিহরণ। ঘুম ভেঙেছে পাখ-পাখালির। তাদের মুখরিত কলরব চারদিকে তৈরি করেছে ব্যস্ততার আবহ। সবুজ ঘাসের মাথায় জমে থাকা শিশিরবিন্দুর ওপর রোদের ছোঁয়া এসে লাগায় সেগুলো স্বর্ণরেণুর মতন ঝলমল করে উঠলো। ভোর হয়েছে।
জালাল মাস্টারের বাড়িতে শোক যাপনের একটা আগাম প্রস্তুতি নেওয়া ছিলো, কেবল আনুষ্ঠানিক যাত্রা পর্বটাই বাকি। শহিদুলদের আগমনে যেন সমস্ত শোক আছড়ে পড়লো বাড়িটার প্রশস্ত উঠোনে। বাড়ির মহিলারা ডুকরে কেঁদে উঠলো। হায় হায় রব উঠলো আকাশে-বাতাসে। শহিদুলের মা, পাথর হয়ে বসেছিলেন উঠোনের এক কোণে। শহিদুলের কোলে চাদরে মুড়ানো নিথর শরীরটার দিকে দৃষ্টি পড়তেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনিও। বুক চাপড়ে কান্না-বিজড়িত গলায় বলতে লাগলেন, এ কী হলো রে ব্যাটা তোর! এ কী হলো!’