মানুষকে প্রেম-ভালোবাসা শেখাতে ব্যস্ত থাকা আমাদের সাহিত্যিক সমাজ কোনোদিন এই জীবনাচার, এই জীবনপদ্ধতির ভেতরে ঢুকে দু’কলম লিখবার তাড়না কেন যে অনুভব করেন না, সেটাই বড় আশ্চর্যের।
আরেকটা ব্যানোর কথা বলি–এদেশে মোটা দাগে যাদের আমরা সাহিত্যিক বলে চিনি, তাদের কাছে ইসলামি জীবনাচার সমৃদ্ধ যে সাহিত্য, সেই সাহিত্য কখনোই ‘বাংলা সাহিত্য’ নয়, সেটাকে তারা বলেন ‘ইসলামি সাহিত্য। কেবল ইসলামি অনুষঙ্গ, ইসলামি জীবনব্যবস্থাকে সাহিত্যে ফুটিয়ে তুলতে গেলেই সেই সাহিত্যকে তারা ধরে-বেঁধে বাংলা সাহিত্যের গণ্ডি থেকে বের করে দিচ্ছেন!
অথচ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যখন স্বরস্বতী পূজোর বন্দনা করে কোনো গল্প লেখে কিংবা বুদ্ধদেব বসু যখন মহাভারতের পথে নামক বই লেখে অথবা মানিক বন্দোপাধ্যায়ের লেখায় যখন গভীরভাবে ফুটে ওঠে সমাজতন্ত্রের সুর–তখন কিন্তু আমরা তাদের বাংলা সাহিত্য থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিই না। আমরা বলি না, ওটা ‘হিন্দু সাহিত্য কিংবা কমিউনিস্ট লিটারেচার’, আমরা বরং তাদের আরো মহান, আরো উদার হিশেবে গণ্য করি। কেবল সাহিত্যের মধ্যে ইসলামি দর্শন ঢুকলেই আমাদের যাবতীয় আপত্তি–ওটা বাংলা সাহিত্য নয়, ওটা ইসলামি সাহিত্য।
বাংলা সাহিত্যের দুনিয়া থেকে এই খবরদারির অবসান কবে হবে?
এই খবরদারির অবসানের একটা রাস্তা আমি চিনি–অনেক বেশি ইসলামি জীবন-দর্শন নির্ভর সাহিত্য রচনা করা এবং সেই সাহিত্যগুলোকে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধে ছড়িয়ে দেওয়া। সাহিত্যের মাঝে এতোদিন যেখানে অবাধ মেলামেশার কথা থাকতো, আমরা সেটাকে হালাল মেলামেশার গল্প দিয়ে ঢেকে দেবো। ইসলামি জীবনাচারের সকল অনুষঙ্গ নিয়ে আমরা গল্প লিখবো, কবিতা লিখবো, লিখবো উপন্যাস। তাহলেই, আমাদের এই ছোট ছোট পদক্ষেপগুলো একদিন বিশাল ঢেউ হয়ে সমুদ্রের কূলে আছড়ে পড়বে আর সেই ধাক্কার রেশ বিস্তৃত হবে অনেকদূর, ইন শা আল্লাহ।
বলা যায়, এমন একটা চিন্তা থেকেই জীবন যেখানে যেমন গল্পের বইটির সূত্রপাত। ইসলামি জীবনদর্শন নিয়েও যে গল্প লেখা যায়, ইসলামকে উপজীব্য করেও যে রচনা করা যায় সাহিত্য–এই বোধটা জাগ্রত করবার একটা ক্ষুদ্র প্রয়াসের নাম জীবন যেখানে যেমন৷
বইতে বেশ অনেকগুলো গল্প রয়েছে। আমি চেষ্টা করেছি গল্পগুলোকে গতানুগতিকতার আবহ থেকে যথাসম্ভব দূরে রেখে এমন এক ধারা তৈরি করতে যা একজন গল্প-পাঠককে যেমন গল্পের আনন্দ দেবে, অন্যদিকে ইসলামি জীবনাচারের ব্যাপারেও শ্রদ্ধাশীল ও আগ্রহী করে তুলবে।
জীবনের বিভিন্ন পর্যায় নিয়ে গল্প লিখবার চেষ্টা করেছি। গল্পে কখনো পিতা, কখনো সন্তান, কখনো স্বামী, আবার কখনো নিরেট বন্ধু হিশেবে জীবনকে দেখাতে চেয়েছি। জীবনের নানা দিকের গল্প যেহেতু আছে, তাই গল্পগ্রন্থটির নামকরণ করেছি জীবন যেখানে যেমন৷ সাজিদ সিরিজের বাইরে এটাই আমার প্রথম একক মৌলিক গল্পগ্রন্থ।
প্রথম কাজ হিশেবে এতে ভুলত্রুটি থেকে যাবে এটাই স্বাভাবিক। সেই ভুলগুলো একান্ত আমার নিজস্ব ভেবে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবার এবং সেগুলো সংশোধন করবার সুযোগ পাবো–এটাই কাম্য। গল্পগুলো কতোখানি গল্প হয়ে উঠেছে কিংবা বইটি সাহিত্যমানে কতোখানি উত্তীর্ণ সেই আলাপ বোদ্ধ মহলের জন্য তোলা থাকুক। মহান রাব্বল আলামিনের কাছে করজোড়ে ফরিয়াদ–তিনি যেন আমাদের ভুলগুলো ক্ষমা করে দেন এবং আমাদের কাজগুলোকে অনন্ত জীবনে নাজাতের অসিলা বানিয়ে দেন। আমিন।
আরিফ আজাদ।
.
সূচিপত্র
- অশ্রু ঝরার দিনে
- এই প্রেম, ভালোবাসা
- আসমানের আয়োজন
- চাওয়া না-চাওয়া
- এক বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যা
- জীবনের রকমফের
- হিজল বনের গান
- বিশ্বাস
- সুখ
- বোধ
- বাবাদের গল্প
- টু-লেট
- মহীয়সী
- সফলতা সমাচার
০১. অশ্রু ঝরার দিনে
জোছনা প্লাবিত রাতের ধবধবে শাদা আকাশ। কোথাও যেন ডাহুক ডাকছে। বুনো ফুলের গন্ধে বাতাস আশ্চর্যরকম ভারী। চাঁদের আলোতে নদী পাড়ের বালিগুলো রুপো চূর্ণের মতো ঝিকমিক ঝিকমিক করছে। থেকে থেকে কানে আসছে কিছু পাতি শেয়ালের ডাক। এসবের বাইরে পুরো দুনিয়াজুড়ে যেন গা ছমছমে নীরবতা। কোথাও কোনো সাড়াশব্দের বালাই নেই।
জোছনার জোয়ার ভেদ করে, গ্রামীণ মেঠো পথের ধুলো উড়িয়ে, বুনো ফুলের বুনো গন্ধকে পাশ কাটিয়ে দুজন মানুষ গন্তব্যে ফিরছে। দুজন বলা কি ঠিক? ওদের সাথে তো আরও একজন আছে। চাদরে মোড়ানো বরফ-শীতল আস্ত একখানা শরীর–নড়চড়বিহীন। তাকেও কি গোনায় ধরা যায়? জীবনের সম্ভাব্য সকল পাঠ চুকিয়ে যে পাড়ি জমিয়েছে অন্য জগতে, এই জগতের বাসিন্দাদের তালিকায় তার নাম উঠানো উচিত হবে?
মাঝে মাঝে বলদগুলো চেঁচিয়ে উঠছে। গোঙানি উঠলেই তাদের পিঠে বসে যাচ্ছে শাদু মিয়ার বেতের বাড়ি। এই জোছনা মুখরিত রাতে, অরণ্যের এই সরু পথ চিনে চলতে বলদগুলোর বিশেষ অসুবিধে হবার কথা নয়। তবু পথ চলতে আজ তাদের রাজ্যের অনীহা। কে জানে, চাদরে মুড়ানো ওই যে নিথর শরীর, তার ভারে হয়তো তারা ক্লান্ত হয়ে পড়ছে বারংবার। এ ভার বয়ে নিয়ে যাওয়া কি এতোই সোজা?
সত্যিই কি সোজা নয়? যদি নাই বা হবে, শহিদুলের কোলের ওপর ওই নিথর শরীরখানা, ওভাবে নিশ্চিন্তে পড়ে আছে কীভাবে? যে পাথুরে শরীরের ভার বইতে বলদেরা অপারগ, তার ভার কতো সহজেই বয়ে নিয়ে যাচ্ছে শহিদুল। তার কোলে কেমন নিবিড় নিশ্চিন্তে পড়ে আছে ওই দেহখানা। শহিদুলেরও যেন কোনো ক্লান্তি নেই। সেও নিরাবেগ, নিশ্চল, নিশ্চপ।